ফুসতাত থেকে দুবাই (পর্ব-২)

এহসানুল হক জসীম
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ২৫

৭৬২ সালে বাগদাদ প্রতিষ্ঠা করেন খলিফা আল-মনসুর। আবহাওয়া, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সামরিক দিক বিবেচনায় রেখে শহরটি নির্মাণ করা হয়। বাগদাদ নগর প্রতিষ্ঠার পর ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাক্কা শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে নগরসভ্যতা বিকাশে মুসলিমরা পৃথিবীতে ব্যাপক অবদান রেখেছিল। একটা পর্যায়ে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ে, নগরসভ্যতায় পিছিয়ে পড়ে। ইউরোপের শহরগুলো তখন এগোতে থাকে বা ইউরোপে নগরসভ্যতা বিকশিত হতে থাকে। বর্তমান পৃথিবীতে নগরসভ্যতায় ইউরোপ এগিয়ে। কিন্তু দুবাই শহর যেভাবে উন্নতি করেছে এবং উন্নত হচ্ছে তাতে ইউরোপের বহু উন্নত শহরকে ছাড়িয়ে গেছে। দুবাই শহরের চাকচিক্য মুসলিমদের নগরসভ্যতার অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ফুসতাতের কথা মনে করিয়ে দেয়।

বিজ্ঞাপন

ফুসতাত শহরের নামকরণের একটি মজার কাহিনি প্রচলিত আছে। জনশ্রুতি আছে, একটি পাখির কারণে এই নামকরণ। হযরত উমর (রা.) এর নির্দেশে মিশর বিজয় করেন মুসলিম সেনাপতি হযরত আসর ইবনুল আস। তৎকালীন মিশরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণের আগে আমর ইবনুল আস নীল নদের পূর্ব তীরে শিবির স্থাপন করেন। এই সময় একটি পাখি তাঁর তাঁবুতে আশ্রয় নেয়, বাসা বানায়, ডিম পাড়ে। যুদ্ধ শেষ হলো, মিশর জয় হলো, কিন্তু পাখি তথা জীবের প্রতি ভালবাসা থেকে আমর ইবনুল আস সেই তাঁবুটি গুটিয়ে নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। রোমান শাসনের অবসান ঘটিয়ে মিশর জয়ের পর আলেকজান্দ্রিয়াকে রাজধানী করতে চাইলেন সেনাপতি আমর ইবনুল আস। উমর (রা.) অনুমোদন না করে বললেন, নতুন কোন জায়গায় মুসলিম মিশরের প্রথম রাজধানীর গোড়াপত্তন করতে। নতুন রাজধানী নির্মাণের জন্য ওই তাঁবুর স্থানটি রাজধানীর কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেন সেনাপতি আমর ইবনুল আস। মিশরীয় ভাষায় ফুসতাত অর্থ তাঁবু। শহরটির নাম ফুসতাত বা তাঁবুর শহর হয়ে যায়।

ফুসতাত এখন পুরোনো কায়রো নগরীর অন্তর্ভুক্ত একটি এলাকা। সেই সময় ফুসতাতে বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক ভবন ছিলো। কিছু ভবন সাত তলা পর্যন্ত ছিলো এবং এসব ভবনের প্রত্যেকটিতে কয়েক শত বাসিন্দা থাকতে পারতো। কেউ কেউ বলেছেন, চৌদ্দতলা পর্যন্ত ভবন ছিলো। এ থেকে কল্পনা যায়, সহস্রাধিক বছর আগেও ফুসতাত কতটা এগিয়ে ছিলো পৃথিবীর অন্যান্য অনেক শহরের তুলনায় আর নগর সভ্যতা ও নগরায়ণের বিকাশে মুসলিমরা কতটা প্রাগ্রসর ছিলো। যে মুসলিমরা ফুসতাতের মতো নগরীর গোড়াপত্তন করেছিলো, কায়রোর মতো বিখ্যাত নগরী গড়ে তুলেছিলো, সেই মুসলিমদের হাত ধরে নগর সভ্যতা আরো বিকশিত হওয়ার কথা ছিলো। যাহোক, দুবাই আজ মুসলিম বিশ্বের একটি আধুনিক নগরী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দুবাই বর্তমান পৃথিবীর একমাত্র চাকচিক্যময় শহর নয়। তবে পৃথিবীর বহু উন্নত শহরকে ছাড়ায়ে গেছে ইতোমধ্যে। দিন দিন এই শহর চাকচিক্যে আরো এগিয়ে যাচ্ছে। নগরায়ণ এবং নগরের সকল সুযোগ-সুবিধার থেকে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শহরে পরিণত হচ্ছে।

২০২৪ সালের এপ্রিল মাস। দুবাই-সহ পুরো সংযুক্ত আরব আমিরাতে বৃষ্টি হয়। আষাঢ়ের বৃষ্টি নয়, আমাদের দেশের ভরা ভাদরের বৃষ্টি হয়েছে। তবে ১৬ এপ্রিল তারিখে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়, বাংলাদেশের ঘন আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো। ২৪ ঘণ্টায় আরব আমিরাতে সর্বোচ্চ ২৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এই বৃষ্টিতে থমকে যায় আধুনিক শহর দুবাই, পৃথিবীর চকচকে ঝকঝকে শহর দুবাই, স্বপ্নের শহর দুবাই। একদিনের এই অধিক বৃষ্টিপাতের পর এই শহরের রাস্তায় কোথাও কোথাও পানিতে ডুবে যাওয়া যানবাহন পরিত্যক্ত হওয়ারও ঘটনা ঘটেছে। মরুর দেশের রৌদ্রোজ্জ্বল নগরীর শান্ত প্রকৃতিতে অভ্যস্ত বাসিন্দাদের কাছে ১৬ এপ্রিলের বৃষ্টিপাত সর্বনাশীই ছিলো। এই দেশের ৭৫ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করা এই দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত আধুনিক শহর দুবাইতে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং যেটুকু ক্ষতি সাধন করেছে, তা ইতঃপূর্বে প্রত্যক্ষ করেনি এখানকার কেউ। সেই রেকর্ড বৃষ্টি ও বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শী এই আমিও। মনে হয়, ৭৫ বছরের রেকর্ড বৃষ্টিপাত প্রত্যক্ষ করার জন্য ওখানে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রতিবেশী ও বাল্যবন্ধু নাজমুল ইসলামের (পিতা: হাজী ফয়জুর রহমান, সাং ব্রাহ্মণগ্রাম, কানাইঘাট, সিলেট) বাসায় ছিলাম সেদিন। আটকে যাই। প্রায় এক সপ্তাহ দূর কোথাও যেতে পারিনি। দুবাই শহরের ইন্টারন্যাশনাল সিটি আবাসিক এলাকার বাইরে বের হওয়ার সুযোগ হয়নি। এই শহরের অন্য এলাকায় বসবাসরত কমিউনিটি বাংলাদেশি নেতা ও কানাইঘাট প্রবাসী সমাজকল্যাণ পরিষদ ইউএই এর সভাপতি জুনেইদ আহমদের সাথে মিটিং হওয়ার কথা ছিলো। এক সপ্তাহের মধ্যে উভয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার বার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি শহরের বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতা থাকায়। (চলবে)

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত