মোহনীয় প্যারিসের অপরূপ ‘সেন নদী’

শাহ সুহেল আহমদ, ফ্রান্স
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭: ৫৩

ভালোবাসার শহর কিংবা স্বপ্নের শহর যে নামেই ডাকুন, ভুল হবে না। মোহময় প্যারিসকে বিশ্বের একেকজন গুণি একেক রকম নাম দিয়েছেন। তবে শিল্প-সাহিত্যের শহর আর ভালোবাসার শহর নামেই বেশ পরিচিতি প্যারিসের।

বিজ্ঞাপন

অপরূপ এই প্যারিসের আরেক আশ্চর্য ধরা হয় প্যারিসের বুক চিরে বয়ে চলা সেন নদীকে। এই নদীর ধারে বসে কত শত-সহস্র কবিতা জন্ম নিয়েছে তার হিসেব নেই বটে, তবে বিশ্ববিখ্যাত কবিদের বিভিন্ন লেখায় তা কিছুটা অনুমেয়। তাদের অনেকের লেখায়ই এ নদীর মাহাত্ম্য ফুটে ওঠেছে।

রাজধানীর মতো মানুষের কোলাহলযুক্ত একটি শহরের বুকে সন্ধ্যা কতটা উপভোগ্য হয়, সে অনুভূতি মেলে প্যারিসের সেন নদীতে। যখন সন্ধ্যা নামে, চারপাশের সমস্ত ঐতিহাসিক স্থাপত্যে আলো জ্বলে ওঠে, রঙ-বেরঙয়ের কত রূপই না ধরে প্যারিস।

বাংলায় যেকোনো নদ-নদীর গঠনরূপ, পর্যায়, প্রকৃতি ও ক্রিয়াকাণ্ড নিয়তই বিবর্তনশীল। তাছাড়া নদ-নদীর এই নিরন্তর ছুটে চলার সঙ্গে মানুষ নিবিড়ভাবে একাত্ম হয়ে আছে। কিন্তু সেন নদীর পাশ দিয়ে যখন হাঁটবেন, দেখবেন নীল জলরাশির পুরো নদীকে নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয়েছে। দূষিত বুড়িগঙ্গা দেখতে দেখতে কোনো রাজধানীঘেঁষা একটা নদীর কথা শোনলেই আমাদের সহজ ধারণা- ঘোলা পানি, দুর্গন্ধ আর নদীতে ভেসে থাকা শহরের নানা বর্জ্য বয়ে চলবে নদীটি। প্যারিসও একটি রাজধানী শহর। কিন্তু সাজানো-গোছানো সেন নদীর দুই পার, কোথাও অট্টালিকা আবার কোথাও গাছপালায় প্রকৃতির অপরূপ সাজ নিয়ে এ নদীর চলা। অনেকটা স্বচ্ছ পানির মতো বহমান এ নদী। তারপর তো আছে শতাব্দী প্রাচীন সেতুগুলো। সেন নদীর ওপরে সেই শতাব্দী প্রাচীন অলংকৃত সেতুগুলো যেন আরও সৌন্দর্য যোগ করে।

প্যারিসকে ভালো করে দেখতে হলে দিনের আলোয় সেন নদীর বুকে বোটে ভেসে ভেসে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন অসংখ্য ভ্রমণ লেখক। আবার কেউ বলেন দিনে নয়– সেন নদীতে ভেসে রাতের আলোকিত অপূর্ব প্যারিসকে দেখা উচিত। কিন্তু ভ্রমণ লেখকেরা বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- সন্ধ্যার ঠিক আগে প্যারিসের মতো বড় শহরের সমস্ত ব্যস্ততাকে একপাশে সরিয়ে রেখে সেনের বুকে যেন এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে, তবে সেটি আগস্ট-সেপ্টেম্বরে উত্তম সময়।

আর শীতে! যেহেতু শীতের রাজ্য প্যারিস, সেহেতু শীতের হাওয়ার সঙ্গে তালমিলিয়ে সেইনের জল হাওয়ার ছোঁয়ায় বোট রেস্টুরেন্টের ছাদে দাঁড়িয়ে প্যারিসকে দেখার রোমাঞ্চই আলাদা ।

সেইনের তীর ধরে যদি হাঁটতে থাকেন, একটু পরপর একেক রকম দৃশ্য চোখে পড়বে। কোথাও সারি সারি নানা রকম গাছের সমাহার, কোথাও নীল জলরাশিকে সামনে রেখে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য রাখা হয়েছে বেঞ্চ। নদীর পারে কোথাও যদি একটু ময়লা চোখে পড়বে মনে করে হাঁটেন, তবে আপনি এখনও প্যারিস নিয়ে বোকার রাজ্যে রয়েছেন। শুধু সেন নদীর তীরই নয়, গোটা প্যারিসকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টার কোনো কমতে রাখেনি কর্তৃপক্ষ। তবে ইদানিং বিদেশি অধ্যুষিত দু-একটি এলাকা তার ব্যতিক্রম।

পড়ন্ত বিকেলে বের হলে দেখা যায়, নদীর তীরঘেঁষে খাবারের পসরা বসিয়ে অন্যরকম এক বিকেল উপভোগ করছে পর্যটকেরা। নদীর দুই পাশ সান বাধানো ওয়াল দিয়ে পানি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে। নদীর পানি এলাকা ভেদে স্তরে স্তরে কমবেশি করে রাখা হয়েছে। মাঝারি আকারের নদী হলেও এ নদী দিয়ে দেদারছে লঞ্চ চলতে পারে। তবে তাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। সেন নদীর ঠিক পাশে দুটি লেন করে রাখা হয়েছে। একটিতে মানুষ হাঁটে অন্যটিতে সাইকেল।

রিভার ক্রুজে করে সেন নদী ভ্রমণে বের হলে একসঙ্গে প্যারিসের মূল আকর্ষণীয় স্থাপত্যগুলো দেখা হয়ে যাবে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর মিউজিয়াম, নর্ত দ্যমসহ এমন সব স্থাপত্যশৈলী এই সেন নদীর তীর ঘিরেই।আমাদের দেশে বেশির ভাগ নদ-নদীর জন্ম পাহাড়ে। তবে সেন নদীর জন্ম পূর্ব-মধ্য ফ্রান্সে দিজোঁ শহরের কাছে লঁগ্র মালভূমিতে। তবে জন্ম যেখানেই হোক না কেন, সবার উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। ঘুরে ফিরে সাগরের কাছে ছুটে চলা। সেন নদীরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্যারিস বেয়ে রুঅঁ শহরগুলির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ইংলিশ চ্যানেলে পতিত হয়েছে। প্রাচীনকালে নদীটি সেকুয়ানা নামে পরিচিত ছিল।

সেন নদীর মোহনাটি প্রায় ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং এটির দুপাশে ল্য আভ্র এবং ওঁফ্লর বন্দর শহরগুলো অবস্থিত। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ৭৭৬ কিলোমিটার। মোহনা থেকে ৫৬০ কিলোমিটার উজানে বার-সুর-সেন শহর পর্যন্ত নদীটি নৌপরিবহনের উপযোগী। এছাড়া সমুদ্রগামী জাহাজগুলো মোহনা থেকে ১২১ কিলোমিটার উজানে রুঅঁ শহর পর্যন্ত যেতে পারে। সেন নদীর অববাহিকার আয়তন প্রায় ৭৭ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার। উত্তর থেকে ওব, মার্ন, ওয়াজ এবং দক্ষিণ দিকে থেকে ইয়োন ও ওর উপনদীগুলো সেন নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এছাড়া নদীটি খালের মাধ্যমে এস্কো বা শেল্ডে, মোজ, রাইন, সোন এবং লোয়ার নদীর সঙ্গে যুক্ত।

কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন- ‘আমার বুকের কাছে নদী ছোটেছিল কবে যেন, এখন এয়োতি মহিলার মতো কালো ছল ভরা জলে সময় ও প্রাণসাগরের-প্রাণসাগরের কথা বলে।’ সেন নদীও যেন কবির এই মহিলার মতো কালো ছল ভরা জল নিয়ে বয়ে চলেছে নিরবধি। প্যারিস ঘুরানো পর্যটকদের কেউ কখনও সেন নদী দেখা থেকে বিরত থেকেছে বলে মনে হয় না। আপনিও মিস করবেন না নিশ্চিত।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত