কাওয়ালি সংগীত যেভাবে এলো বাংলায়

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮: ৪৬

শীতের রাতে ঝলমলে প্যান্ডেল, হারমোনিয়ামের তালে গানে গানে সুফিবাদ, আল্লাহ ও নবী (সা.)-এর প্রতি ভক্তি, আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ ও গুণগান সংগীতপ্রেমী বাংলার শত বছরের ঐতিহ্য। কাওয়ালি নামে পরিচিত সংগীতের এই ধারা জয় করেছে সব শ্রেণির মানুষের হৃদয়। বাংলায় যারা কাওয়ালি চর্চা করছেন, নাদিম কাওয়াল তাদের অন্যতম। তার পুরো নাম মোহাম্মদ নাদিম এহতেশাম রেজা খাঁ।

বাংলাদেশে কাওয়ালির আগমন তার পূর্বপুরুষদের হাত ধরে। সারা বছর তুমুল ব্যস্ত নাদিম কাওয়াল। শীতে তো দম ফেলার জো নেই। বাংলায় কাওয়ালির ইতিহাস ও আবির্ভাব জানতে চাইলে খুলে বসেন গল্পের ঝাঁপি। আমার দেশকে বললেন, ‘৬০০ বছর আগের কথা। আমাদের পূর্বপুরুষরা ইরাকের নাজাফ থেকে ভারতবর্ষ আসেন। তারা ভারতের আজমীর শরীফে আবস্থান নেন। খাজা গরীবে নেওয়াজের মাহফিলে উর্দু ভাষায় কাওয়ালি পরিবেশন করতেন। সেখানে আমার বড় দাদা ২৯ বছর কাওয়াল হিসেবে ছিলেন। পরদাদাও ছিলেন একই দায়িত্বে। শেষের দিকে আমার বাবা কাওয়ালি পরিবেশন করেছেন নয় বছর।’

বিজ্ঞাপন

নাদিম কাওয়াল বলেন, ‘হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনি (রা.), হযরত শাহ পরাণ (রা.)-সহ অনেক সুফি-সাধক ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসেন। তাদের সঙ্গে বাংলায় কাওয়ালদের আগমন ঘটে। কাওয়ালরা ঢাকার নবাবদের বিশেষ মেহমান হিসেবে গুরুত্ব পেতেন। নবাব সলিমুল্লাহ খান, নবাব হাবিবুল্লাহ খানসহ তখনকার নবাবরা সুফি-সাধকদের বায়াত গ্রহণ করেন। এভাবে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা দিল্লি ও ঢাকায় যাতায়াত করতেন। আহসান মঞ্জিলের সামনে, ওয়াইজ ঘাটে আমার বড় দাদার মাজার শরীফ আছে।’

পূর্বপুরুষদের নাম উল্লেখ করে নাদিম কাওয়াল বলেন, ‘হযরত নাজমুল হাসান আবু ইলাহি নকশবন্দি ভারতের পাটনা মিতান ঘাট থেকে বাংলায় আসেন। তার সঙ্গে বেহের শরিফ থেকে তার ওস্তাদ হযরত মাখদুম জাহান মখদুম শরফুদ্দীন আহমাদ সোনারগাঁও আসেন। সোনারগাঁওয়ে তার মাজার আছে।’

পূর্বপুরুষদের লেখা ও গাওয়া গান নিয়ে তিনি বলেন, “আমার পূর্বপুরুষ আমীর খসরু ছিলেন খাজা নিজাম উদ্দিনের দরগার কাওয়াল। তিনি লিখেছিলেন ‘মুঝে আপনেহি রঙ মে রঙ দে নিজাম’। গানটি পরে পাকিস্তানের জনপ্রিয় কাওয়াল শিল্পী নুসরাত ফতেহ আলী খান গেয়েছেন। গানটি সুফিবাদীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। আমীর খসরুর অনেক জনপ্রিয় গানই নুসরাত ফতেহ আলী খান গেয়েছেন।”

বাংলার এই কাওয়াল শিল্পী বলেন, ‘দেশভাগের আগে আমার পরদাদা আমীর রেজা খাঁ, দাদা ক্বায়াম রেজা খাঁ, বাবা এহতেশাম রেজা খাঁ পাকাপাকিভাবে ভারত থেকে বাংলায় চলে আসেন। বাংলায় আমার বংশধরদের আগমনের ইতিহাস আর কাওয়ালির ইতিহাস একই সুতোয় বাঁধা।’

নাদিম বলেন, ‘বাংলায় আমার চার পুরুষ কাওয়াল চর্চা করার পাশাপাশি অসংখ্য ছাত্রের মাধ্যমে সারা বাংলায় কাওয়াল ছড়িয়ে দিয়েছেন। এখন দেশে যত শিল্পী আছেন প্রায় সবাই আমার বাবা-দাদার সঙ্গে থেকে হারমোনিয়াম, ঢোল বাজিয়েছেন। এরপর নিজেরাই চর্চা শুরু করেছেন। এভাবেই বাংলায় কাওয়ালি সংগীত ছড়িয়ে পড়েছে।’

তিনি জানালেন, বর্তমান বাংলাদেশে ঢাকার লালবাগের সমির কাওয়াল, হাসান কাওয়াল, জেনেভা ক্যাম্পের জাহান কাওয়াল, মানজার কাওয়াল, জাহাঙ্গীর কাওয়াল, নূর আলম কাওয়াল, চট্টগ্রামে আবু কাওয়াল, ইসলাম কাওয়াল, উকিল কাওয়াল, নারায়ণগঞ্জে হারুন কাওয়াল, ইসলাম কাওয়ালরা বেশ নাম কামিয়েছে। একঝাঁক কাওয়াল শিল্পীর হাত ধরে বর্তমানে সারা দেশে সংগীতের এই ধারা ছড়িয়ে পড়েছে।

সংগীতের এই দুরবস্থার যুগে কাওয়াল সংগীত টিকবে কি না জানতে চাইলে নাদিম কাওয়াল বলেন, ‘সারা দেশ থেকে আমরা দাওয়াত পাই। শীতে আয়োজন বেশি হলেও সারা বছর কম-বেশি দাওয়াত থাকেই। গান-বাজনা করে আমি তো খুবই ভালো আছি। গান যদি শিল্পীকে ভালো থাকার বন্দোবস্ত করে শিল্পীও গানের জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন বিধায় কাওয়াল টিকে থাকবে। আমার পরে আরও ভালো ভালো শিল্পী আসবেন। তারা সংগীতের চিরতরুণ এই ধারা ধরে রাখবেন বলেই বিশ্বাস করি।’

তিনি জানালেন, দেশে এমন জেলা বাদ নেই যেখানে তিনি অনুষ্ঠান করেননি। খাজা গরীবে নেওয়াজের অনুসারিরা তার গানের প্রধান শ্রোতা। মাজারগুলোতে তাদের সংগীত চর্চার প্রধান কেন্দ্র বলে মানেন। এর বাইরেও অনেকে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে ডাকেন কাওয়াল শিল্পীদের।

কাওয়ালি লিখতে আধ্যাত্মিক সাধনা লাগে। যে কেউ চাইলেই এই গান লিখতে পারেন না। যে কারণে নতুনরা কাওয়ালি লিখলেও শ্রোতাদের কাছে এখনো পুরোনো গানগুলোই জনপ্রিয়। পুরোনো গানগুলো এতটাই আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ, এতটাই সহজ-সরল ও নন্দিত সুর যে, ওই গানগুলো কখনো পুরোনো হবে না বলে মনে করেন নাদিম কাওয়াল।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত