সিঁড়ির মাথায় যাওয়ার আগেই থামল। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল—না, এই পর্যায়ে এসে এতটা ক্লান্ত হওয়া যাবে না। সে ভালো করেই জানে, সে কখনোই ক্লান্ত নয়, ভীতু নয়! গাড়িটা হোটেলের সামনে রেখেছে, হাতে একটি ছোট ঝুড়ি। সামনের সিঁড়িটা, তাও তেমন দীর্ঘ নয়। কিন্তু শেষের এই তৃতীয় ধাপটাই তাকে প্রতিবার ভেঙে ফেলে, পরাস্ত করে, হাঁটু কাঁপায়, এগোতে দেয় না, আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে দেয়। এগোয়, সিঁড়িতে তার হাতের ঝুড়িটা রাখে। পিঠটা দেওয়ালে ঠেকিয়ে দেয়; ভাবে—থাকবে নাকি ফিরে যাবে, থাকবে নাকি ফিরে যাবে! এক আজব প্রশ্ন মনে জাগ্রত হলো তার। তবুও তা ঝেড়ে ফেলতে পারল না। এমন প্রশ্ন, যে প্রশ্নটা মাথায় ঘণ্টাধ্বনির মতো বাজতে লাগল বারবার। ফিরে কি যাব, নাকি যাব না—ঘোর দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিতে চেতনাজুড়ে রক্তের শিরায় শিরায় ভেসে উঠল দুই বছর আগের সেই মুহূর্ত। তখনো সে এই একই প্রশ্ন করেছিল নিজেকে। আর এক মুহূর্ত পরেই গাড়িতে চড়ে ফিরে গিয়েছিল জেরুসালেম ছেড়ে। আজও কি ফিরে যাবে আবার? তখনই ঝুড়ির দিকে এক নজর তাকাল। অকস্মাৎ ঝুড়িটি হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরে ওপরে লাফিয়ে উঠল। যেন সমস্ত শক্তি দিয়ে কাদার হ্রদ থেকে নিজেই নিজের শক্ত ও ভারী শরীরটাকে ওপরে পাড়ে ওঠাল!
না, এবার আর ফিরব না, এই সীমানায় এসেও এতটা কাপুরুষ হওয়া লজ্জাজনক। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে আমি আপন কাঁধে এক দীর্ঘ ভয়ংকর দায়িত্ব বহন করে আসছি। এখন এই ম্যান্ডেলবাম গেটের কাছে তা ধুয়ে ফেলতে হবে। ম্যান্ডেলবাম গেটটি পাথরের বিভাজনে দাঁড়িয়ে আছে দখলদার আর মুক্তিকামী মানুষের ভূমির মাঝামাঝি। না, না, এবার আর কিছুতেই ফিরব না। এই দীর্ঘ মিথ্যার ধকলের অবসান ঘটাতেই হবে, স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে। আমি কিছুই জানি না, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে!
দুই বছর আগে জেরুসালেমে পৌঁছার সময় ভেবেছিল সে মায়ের মুখোমুখি হয়ে সব বলবে। কিন্তু হোটেলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই বুঝেছিল, সে সেই দীর্ঘ মিথ্যা ঘোচাতে পারবে না, যে মিথ্যা স্বয়ং সে বলেছিল রেডিওতে বার্তা পাঠিয়ে—‘আমি আর দিলাল ভালো আছি, তোমাদের খবর জানতে চাই, ভালো আছ?’
একটা মিথ্যা। তা গত ১০ বছরে এতটাই বিকটভাবে বেড়ে উঠেছে, বড় হয়েছে যে, এক কঠিন, নির্মম সত্য বলার কোনো পথই তার আর জানা নেই। তাই সে সেদিন সিঁড়ি বেয়ে না উঠে গাড়িতে করে ফিরে গিয়েছিল। সেদিন—১০ বছর আগে।
নিশ্চয়ই তার মা সেই সকালের বাতাসজুড়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে তাকে খুঁজছিল আর হতাশার চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু তাও তো তার কাছে এই নির্মম সত্য বলার চেয়ে সহজ! এখানে ১০টা বছর পর তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সেই মারণ সত্য বলা—কীভাবে বলবে!
২
রাতের শামিয়ানা পড়ল। খাটের ওপর শুয়ে আছে সে। হাত দুটো মাথার নিচে। শহরজুড়ে আঁধারের পর্দা নেমে আসছে তখন। তার ঘরে শুধু একটাই চিন্তা করে ঘুরঘুর—আগামীকাল ম্যান্ডেলবাম গেটে যেতেই হবে, মায়ের কাছে। তার মা তাকে চেনা হাত বাড়িয়ে ডাকবে, ধূসর চুল আর অশ্রুভেজা মুখের আলিঙ্গনে! সে তার মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং মরে যাচ্ছে এমন ছোট এক পাখির মতো ছটফট করবে আর ফুঁপিয়ে কাঁদবে। তার ক্ষতবিক্ষত মাথাটি মায়ের মুখের ওপর রাখবে, কোলে ঢেলে দেবে। তখন সে তাকে কী বলবে, যখন সে মায়ের বুকে স্পন্দিত হৃৎস্পন্দনের মতো টের পাবে? তার কোথা থেকে শুরু করা উচিত, কীভাবে সে সব ঘটনার বর্ণনা দেবে?
তারপর সে অন্য পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে তার হার্টবিট শরীরে টানটান গিটারের তারের মতো বাজছে, ধুকপুক করছে। শুরুটা তো তাকে করতে হবে সেদিন থেকে—যখন সে ইয়াফা ছেড়ে আক্কা গিয়েছিল। বিয়ে করবে সে। মায়ের পছন্দের মেয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা। মা তাকে পাঠিয়েছিল মায়ের পছন্দের সেই মেয়েটিকেই দেখতে। সেই মুহূর্তের প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি দৃশ্য তার মনে আছে, ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছে এখানে—মা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তার জন্য দোয়া করছিলেন, বিদায় দিচ্ছিলেন আর তার খালা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন মাকে। তখন তার সঙ্গে ছিল ছোট বোন দিলাল। বছর দশেক বয়সের এক ছোট্ট শিশু। প্রথমবারের মতো সে ভাইয়ের সঙ্গে বাইরে যাচ্ছে, একা মাকে ছাড়া!
কিন্তু হায়, সময় গড়াল এক ভিন্নরকম, ইয়াফা ছেড়ে যাওয়ার কয়েক দিন পরই তারা এই চেনা পথ হারিয়ে ফেলল। পেছনে ফেরা অসম্ভব হয়ে গেল। মায়ের থেকে দূরে এই নিকষ যন্ত্রণার দিনগুলোতে সে শুধু দিলালের চিন্তায় কষ্ট পেয়েছে, দিলালের জন্য ব্যথিত হয়েছে। দিলালই তার মায়ের সবকিছু। বাড়িতে দিলালই সেই বৃদ্ধা মাকে ভালো রাখে, বাঁচিয়ে রাখে যখন মৃত্যু ঘিরে আসে চতুর্থ দিক থেকে! যখন অন্ধকার আক্কা শহরকে গ্রাস করল, তখন তার ভাইয়ের রাইফেলের শেষ গুলিটিও শেষ হয়ে গেল। সেই রাইফেল তখন শুকনো লাঠি ছাড়া আর কী! সে দিলালের কাছে গেল, ভয়াতুর শরীর, থরথর করে কাঁপছিল। সে পৌঁছানোর আগেই দরজায় ধাক্কা পড়ল। একটা রাইফেলের গুলি ঘরে বৃষ্টি-ছিঁটার মতো ছড়িয়ে পড়ল। ধোঁয়ার বাষ্পের ভেতর চারজন ইসরায়েলি সৈন্য দৃশ্যমান হলো। দিলালের বাহুতে মৃত্যুর আগের শেষ কাঁপুনটা কাঁপছিল তখন। যখন ভাই তাকে বুকে চেপে ধরল, দিলাল চোখ তুলে কিছু বলতে চাইল; কিন্তু মৃত্যু তার কথা কেড়ে নিল। ছোট্ট দিলালকে আর কিছুই বলতে দিল না!
সে কি কেঁদেছিল সেদিন? সে এখন কিছুই মনে করতে পারছে না। শুধু এতটুকুই মনে পড়ছে তার, সে তার মৃত বোনকে কোলে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষের দয়া ভিক্ষা চেয়েছিল, আগন্তুকের সাহায্য চাচ্ছিল, যেন একা তার নিজের কষ্টাশ্রুই যথেষ্ট নয়। অচেতন হয়ে পড়ল সে। কখন তার কাছ থেকে লোকেরা তার বোনের মৃতদেহ কেড়ে নিয়েছিল, তাও সে জানে না। তবু যখন দিলালের ঠান্ডা শক্ত দেহটা তার হাত থেকে সরে গেল, তখন সে আঁচ করেছিল সে নিঃস্ব হয়ে গেল, সব হারিয়েছে, অমূল্য কিছু—মা, মাটি, বোন, পরিবার, এমনকি নিজের সামান্য বেঁচে থাকার আশাটাও!
৩
যদি সে মাকে সব বলে দেয় সত্যি সত্যি, তাহলে ১০ বছরের মিথ্যার প্রাসাদ ভেঙে পড়বে। মা জানতে পারবেন, দিলাল ১০ বছর আগেই মারা গেছে, আর তার ছেলে রেডিও বার্তা দিয়ে তাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়েছে; বলেছিল, ‘মা, আমি আর দিলাল ভালো আছি।’
সে জানালায় গিয়ে অন্ধকারে পর্দা সরাল। ঘোমটাপরা রাতের আঁধার ভেঙে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। একমনে ভাবতে থাকল, তাকে অবশ্যই অবশ্যই মিথ্যা থেকে মুক্ত করতেই হবে নিজেকে এই কালো ভাগ্যের থাবা থেকে।
পরদিন সকালে ম্যান্ডেলবাম গেটে তাদের দেখা হবে। সে ভিড়ের মধ্যে তার মাকে খুঁজছিল। কিন্তু পাচ্ছিল না। হঠাৎ তার খালাকে দেখতে পেল। যদিও সে প্রথমে তার খালাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু খালা তাকে চিনে ফেললেন। দেখা হওয়ার পরেই খালা তাকে সেই প্রশ্ন করে বসলেন, যা শোনার জন্যই সে এসেছিল, যার জন্য এত দুঃচিন্তা ও উদ্বেগ ছিল। তার খালা তাকে সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘দিলাল কোথায়?’
তার ছোট কাঁপা চোখে জমে থাকা আত্মবিশ্বাস ও সমস্ত দৃঢ়তাই বরফের মতো গলে গেল। একটা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি খেয়ে গেল শরীরে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে দেদার।
—‘কিন্তু তুমি তো আমাকে বললে না, মা কোথায়?’
তখন সে তার খালার চোখাচোখি হলো আবার। সে তার হাতের ঝুড়িটি এক হাত থেকে অন্য হাতে নিল। আরও কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তার গলায় যেন এক চওড়া ও বাঁকা ছুরি আটকে গেল। খালা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শক্ত করে তার বাহু স্পর্শ করলেন। তার কণ্ঠে অবিশ্বাস্য ব্যথা জেগে উঠল। আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘দিলাল কোথায়? বলো।’
—‘দিলাল…’, এতটুকু বলে আবারও সে দুর্বলতা অনুভব করল।
মনে হচ্ছিল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে, এখনই বন্ধ হয়ে যাবে হৃৎস্পন্দন। হাত কাঁপছিল তার, কাঁপা হাত বাড়িয়ে ঝুড়িটি খালার দিকে এগিয়ে দিল।
—‘এটা আমার মায়ের জন্য নিয়ে যাও। এতে কিছু কাঁচা বাদাম আছে।’
তারপর সে আর কথা শেষ করতে পারল না। বৃদ্ধার চোখে এক ভয়ংকর বিষব্যথা ছড়িয়ে পড়ল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল বৃদ্ধার। সে খালার কাঁধের ওপরে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে আওড়াচ্ছিল—‘সে তাকে ভালোবাসত।’
দুজনের মধ্যে যে বিশাল নীরবতা তৈরি হলো, মুহূর্তেই তা যেন এক সলিল সমাধির মতো সুনসান হয়ে গেল। সে দৌড়ে পালাতে চাইল। খালা তার ছোট ব্যাগে দিলালের শেষ সবুজ পোশাকটি হাতড়ে খুঁজছিলেন। তাদের অন্তর্দাহ বেড়ে বুকের মধ্যে এক আপন সংযোগ তৈরি হলো। তার খালা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখনই দুজনের চোখের দৃষ্টি এক নীরব বেদনার দেশে মিলিয়ে গেল। আর সে তার গলায় আটকে থাকা সেই চওড়া ও বাঁকা ছুরির তীব্র ব্যথা আবারও অনুভব করল। তার চোখ অশ্রুতে জ্বলজ্বল করছিল। সে হাত বাড়িয়ে দিল, পরক্ষণেই তার মুখের দিকে তাকাল। হাত দিয়ে বৃদ্ধার মুখ তার দিকে তুলল। তারপর নিজেকে এক গম্ভীর প্রশ্নের মধ্যে নিক্ষেপ করল!
—‘তুমি কীভাবে বাকি সব ছেড়ে এসেছ? আর ইয়াফা ছেড়ে গেলেই বা কীভাবে?’ তার খালা আরও কিছু বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। গলা ধরে আসছিল, শব্দগুলো আটকে যাচ্ছিল। একটি নিষ্প্রভ, অর্থহীন হাসি হেসে তিনি তার কাঁধে হাত রাখলেন আর সে ম্যান্ডেলবাম গেটের ওপারে অপার দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইল।

