২৬তম আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করছে ইরাক। সারা বিশ্বের ছয়শর বেশি প্রকাশনা সংস্থা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে রাজধানী বাগদাদে গত ১০ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে এই বইমেলা। এটি শুধু বইমেলা নয়, পরিণত হয়েছে সাংস্কৃতিক উৎসবে, যেখানে শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার। আয়োজিত হচ্ছে চিত্রকলা, ক্যালিগ্রাফি, ভাস্কর্য প্রদর্শনী, চিন্তা-সেমিনার ও কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠান।
মেলা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ড. আবদুল ওয়াহাব আল-রাদি বলেন, এই জনসমাগম ইরাকি জনগণের জন্য নতুন জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার প্রতি তৃষ্ণার ইতিবাচক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, মেলার মূল উদ্দেশ্য আধুনিক বিশ্বসাহিত্য ও আরব সাহিত্যের প্রাচুর্যকে ইরাকি পাঠক ও সংস্কৃতিমনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
ডিজিটাল প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে রাদি বলেন, এগুলো শুধু ইরাকেই নয়, বিশ্বজুড়েই প্রকাশনার জগতে প্রভাব ফেলছে। তবে প্রযুক্তি কখনোই বইয়ের বিকল্প নয়, বরং সহায়ক হওয়া উচিত। আমাদের মূলনীতি হলো বই ও ডিজিটাল মাধ্যম—একে অপরের সম্পূরক হবে, কেউ কাউকে বাতিল করবে না।
শুরু থেকেই এই মেলায় প্রতি বছর একটি অতিথি দেশ থাকে, যাকে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে অতিথি দেশের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ইতিহাসনির্ভর প্রোগ্রাম মেলার বিভিন্ন পর্বে মঞ্চায়িত হয়। এ বছর বাগদাদ বইমেলার অতিথি দেশ হিসেবে আছে কাতার।
১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হওয়া এই মেলা ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা ২০ বছর স্থগিত থাকে মূলত উপসাগরীয় অবরোধ এবং আয়োজক দেশ ইরাকের যুদ্ধবিগ্রহপূর্ণ অবস্থার কারণে। ইরাকের শিয়া-সুন্নি লড়াইয়ের জেরও ছিল। ২০০৩ সাল থেকে ছয়-সাত বছর মার্কিন হামলা, সাদ্দাম হোসেনের পতন, হত্যাযজ্ঞ, মিলিশিয়া যুদ্ধ, গাড়িবোমা ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত পুরো দেশকে গ্রাস করে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। এসব ডিঙিয়ে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বইমেলা আবার ফিরে আসে ২০১১ সাল থেকে।
সমৃদ্ধ উপস্থিতি ও প্রকাশনা বৈচিত্র্য
ইরাকের সংস্কৃতি, পর্যটন ও প্রত্নতত্ত্ব মন্ত্রণালয়ের সংস্কৃতিবিষয়ক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় ছয়শর বেশি বই এনেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ম্যাগাজিন আল-মাওয়ারিদ, আল-আকলাম, আল-তারাথ আল-শাবি, আল-সাকাফা আল-আজানাবিয়া ও আল-সাকাফা আল-তুরকমানিয়া।
বাগদাদ বইমেলায় এবারের দর্শকরা বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন সামাজিক উন্নয়ন, দর্শন, শিল্প ও উপন্যাসবিষয়ক বইয়ের প্রতি। আয়োজকরা মনে করছেন, বাগদাদ বইমেলার মতো সাংস্কৃতিক আয়োজন আরববিশ্ব ও দুনিয়ার মধ্যে জ্ঞানবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং এটি আরব পাঠক ও চিন্তাবিদদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিলনমেলা হয়ে থাকবে।
কাতারের প্যাভিলিয়নে রয়েছে একটি আধুনিক ডিজিটাল লাইব্রেরি, যেখানে দর্শনার্থীরা কিউআর কোডের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের সব প্রকাশনা মোবাইলে ডাউনলোড করতে পারেন। কাগজ ও ডিজিটাল বইকে মিলিয়ে দেখানো হয়েছে যে, কাতার আধুনিকায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে এবং কাগজের বই ও ঐতিহ্যকেও ধরে রেখেছে। কাতার প্যাভিলিয়নে ছিল জনপ্রিয় হস্তশিল্প প্রদর্শনী, ইন্টারেক্টিভ স্ক্রিন ও শিশুদের জন্য বিশেষ কর্নার।
সিরীয় প্যাভিলিয়নের প্রতিনিধি ও দিলমুন আল-জাদিদা প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক আফরা হুদবা জানান, দর্শকরা বিশেষভাবে আগ্রহ দেখিয়েছেন মার্কিন নীতিসম্পর্কিত বই, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সাহিত্য ও ঐতিহাসিক গবেষণার বইয়ের প্রতি। বাগদাদ আন্তর্জাতিক বইমেলা নিয়ে ইরাকি কবি বনান অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘সংস্কৃতি হলো সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর কণ্ঠ, যাকে কখনোই নীরব করা যায় না।’

