বিশ্বের ইতিহাসে বিপ্লব-সংগ্রামে শিল্পী-সাহিত্যিকরা দর্শক হয়ে বসে থাকে না। বাংলাদেশের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে গান, কবিতা, ছড়া ও স্লোগানে সৃজনশীল মানুষেরা হয়েছেন ইতিহাসের অনিবার্য অধ্যায়।
জুলাই বিপ্লবও তার ব্যতিক্রম নয়। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই সময়ে কেবল মাঠে ছিলেন না, তাদের সৃষ্টির ভেতরও আন্দোলন চলছিল। দিনে কি রাতে, নিকষ অন্ধকারের ভেতর, গোপন ঘরে বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লেখা হচ্ছিল অগ্নিগর্ভ কবিতা। সেই কবিতাগুলো পরদিন স্লোগানে রূপ নিত, পোস্টারে ছাপা হতো, কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ত দাবানলের মতো।
কবিতা তখন কেবল সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়, বরং সাহসের হাতিয়ার। শব্দ হয়ে উঠছিল ঢাল, কখনো হয়ে উঠছিল মশাল। কবির কলম প্রতিটি শব্দকে রূপান্তর করছিল আগুনে, যা মানুষের অন্তরে ছড়িয়ে পড়ছিল অতি দ্রুত।
কোনো বিপ্লবই কেবল রাজনীতির মাধ্যমে পূর্ণতা পায় না। রাজনীতি জনগণকে সাহসী করে। সাহিত্য সেই সাহসকে উজ্জীবিত করে। মানুষের অন্তর্দেশকে নাড়াতে পারে সাহিত্য ও শিল্প। জুলাই বিপ্লবে এই সত্য আবার প্রমাণিত হলো। রাজপথের স্লোগান যেমন জনতাকে সংগঠিত করেছে, কবিতার অগ্নিমন্ত্র তেমনি দিয়েছে মানসিক বল। যিনি মিছিলে ছিলেন, তিনিই রাতে লিখেছেন কবিতা। আর যিনি কলম ধরেছেন, তার কবিতা আবার ফিরে এসেছে মিছিলে স্লোগান হয়ে। এই পরম্পরা, এই তরঙ্গ জুলাই বিপ্লবকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা।
বিজয়ের পরে অনেকেই অনুভব করলেন এসব কবিতা, প্রবন্ধ ও সৃষ্টিশীল লেখা কেবল সাময়িক আগুন নয়, বরং স্থায়ী দলিল হওয়ার যোগ্য। এগুলো সংরক্ষণ জরুরি। সেই জায়গায় এগিয়ে এসেছে কিছু লিটলম্যাগ। তাদের মধ্যে ‘আড্ডাপত্র’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আন্দোলনের উত্তাপে আড্ডাপত্র প্রথমে অনলাইনে (www.addapatra.com) কবিদের লেখা প্রকাশ করেছে। প্রতিটি পর্বে পাঁচজন করে কবির কবিতা প্রকাশ করা হয়েছে।
ব্যাকগ্রাউন্ড অলঙ্করণে ব্যবহার করা হয়েছে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি। এটি শুধু সাহিত্য প্রকাশ নয়, আন্দোলনের ভেতরেও ছিল তাৎক্ষণিক সাহস জোগানোর কাজ। মানুষ সেই কবিতা পড়েছে, শেয়ার করেছে, আরেকটি মিছিলের শক্তি পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই লেখাগুলো প্রিন্ট আকারে প্রকাশ করেছে ‘আড্ডাপত্র’। ফলে যা ছিল ক্ষণিকের প্রেরণা, তা পরিণত হয়েছে স্থায়ী ইতিহাসে।
জুলাই বিপ্লবের পরপরই আড্ডাপত্র নিয়ে নেয় সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তারা বিশাল কলেবরে প্রকাশ করে বিপ্লবকালের কবিতা সংখ্যাÑ‘গণঅভ্যুত্থানের কবিতা’, ফেব্রুয়ারি ২০২৫’।
কবি মনসুর আজিজ সম্পাদিত আড্ডাপত্র শুধু লিটলম্যাগ নয়—জুলাই বিপ্লবের সাংস্কৃতিক দলিল। আগামী প্রজন্ম যখন পড়বে, কেবল রাজনৈতিক ইতিহাস জানবে না; অনুভব করবে সেই রাতের অন্ধকার, সেই দিনের রোদের উত্তাপ, সেই কবিতার অগ্নিস্রোত। সেই সময়ের সাহসী সাংস্কৃতিক যোদ্ধাদের নাম জানতে পারবে এই সংখ্যাটি পড়ে।
সমগ্র জুলাইকে সংক্ষেপে চিত্রিত করেছেন সম্পাদক মনসুর আজিজ তার ভূমিকা প্রবন্ধে। ডাউশ সাইজের এই লিটলম্যাগের একমাত্র প্রবন্ধ সম্পাদকের। কবিতা-ছড়া মিলিয়ে প্রায় ২৩৮ জন কবি-ছড়াকারের লেখা আছে এ সংখ্যায়।
২৮টি দীর্ঘ কবিতা, ১৩৮টি কবিতা, ৭২টি ছড়া নিয়ে আড্ডাপত্র তুলে ধরেছেন ‘গণঅভ্যুত্থানের কবিতা’ সংখ্যায়। ছড়াকে সম্পাদক কবিতা থেকে আলাদা রেখেছেন। এত সব ছড়া কবিতায় বর্ণিল রঙ্গ, রস ও রূপ মিলিয়ে হাজির হয়েছে জুলাই। সূচি সাজানো হয়েছে নামের আদ্যাক্ষরের সূত্র ধরে। বিশাল কলেবরের প্রায় ২৪০ জন কবির কবিতা গ্রন্থিত।
পৃথক আলোচনায় সবার কবিতা নিয়েই পৃথক আলোচনার দাবি রাখে। আমরা কেবল বলতে চাই, বিপুলসংখ্যক কবিকে একত্র করে ‘আড্ডাপত্র’ নিজের অবস্থান জুলাইসাহিত্যে অনিবার্য করে তুলতে পেরেছে। ‘আড্ডাপত্র’ হয়ে উঠেছে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

