শীতকাল মানেই প্রকৃতির রুক্ষতা। এই সময় ত্বক হয়ে ওঠে শুষ্ক ও প্রাণহীন। সাধারণ মানুষের জন্যেও ত্বকের যত্ন নেওয়া জরুরি; কিন্তু যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাদের জন্য শীতে ত্বকের বিশেষ যত্ন নেওয়া অপরিহার্য। ডায়াবেটিস রোগীদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়, ত্বকে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়, যার ফলে ত্বকের নানা সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
* ত্বকের সমস্যা কেন বিপদঘণ্টা
ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা বা গ্লুকোজ ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা কেড়ে নেয়, যা রক্তনালি ও স্নায়ুর ক্ষতি করে। এর ফলে শীতে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো সহজে দেখা দিতে পারে—
শুষ্ক ত্বক ও চুলকানি : এটি সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। ডায়াবেটিসের কারণে শরীর থেকে জল বেরিয়ে যায় এবং ত্বক দ্রুত শুষ্ক হয়ে ফাটা ও চুলকানির সৃষ্টি করে। শীতে এই সমস্যা আরো বাড়ে।
ছত্রাক সংক্রমণ : উষ্ণ ও আর্দ্র স্থানগুলোয় ছত্রাক দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে অতিরিক্ত শর্করা ছত্রাকের খাবার জোগায়। বিশেষ করে আঙুলের ভাঁজে, স্তনের নিচে, কুঁচকিতে ও নখের চারপাশে লালচে ফুসকুড়ি বা সাদা প্রলেপ দেখা যায়।
ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ : ফোড়া, কার্বাঙ্কেল (অনেকগুলো ফোড়ার সমষ্টি) এবং চোখের পাতায় অঞ্জনি (Stye)। ত্বকে সামান্য আঁচড় বা ক্ষত হলেও তা দ্রুত সংক্রমণে পরিণত হতে পারে।
ডায়াবেটিক ডার্মোপ্যাথি : পায়ের সামনের অংশে ছোট, গোলাকার, হালকা বাদামি বা লালচে দাগ দেখা যায়। সাধারণত ক্ষতিকারক নয়, তবে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে এটি হতে পারে।
অ্যাকান্থোসিস নিগ্রিকান্স : ঘাড়, বগল ও কুঁচকির ত্বক কালো, পুরু এবং মখমলের মতো হয়ে যায়। এটি প্রায়ই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের লক্ষণ।
* প্রতিরোধ ও প্রতিকার
ডায়াবেটিস রোগীদের ত্বকের যত্ন অনেকটা ‘প্রতিরোধই সেরা প্রতিকার’ এই নীতির ওপর নির্ভর করে।
আর্দ্রতা রক্ষা করুন : ময়েশ্চারাইজারের সঠিক ব্যবহার শুষ্ক ত্বকই (Dry Skin) শীতে আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু। এটি ত্বককে ফাটিয়ে দিয়ে সংক্রমণ ঢোকার রাস্তা করে দেয়।
উপায় : প্রতিদিন কমপক্ষে দু’বার ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করুন। গোসলের পর ত্বক সামান্য ভেজা থাকা অবস্থায় (১৫ মিনিটের মধ্যে) ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে তা আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
পরামর্শ : সুগন্ধি ও অ্যালকোহলমুক্ত ঘন ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করুন। ল্যানোলিন, পেট্রোলিয়াম জেলি বা গ্লিসারিনযুক্ত ময়েশ্চারাইজার শুষ্ক ত্বকের জন্য খুবই কার্যকর। তবে আঙুলের ফাঁকে বা ত্বকের ভাঁজে অতিরিক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবেন না, এতে ছত্রাক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
* পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
উপায় : প্রতিদিন ঈষদুষ্ণ জলে (খুব গরম নয়) হালকা সাবান বা শাওয়ার জেল ব্যবহার করে গোসল করুন। গোসলের সময় দীর্ঘ করবেন না।
পরামর্শ : শরীর আলতো করে মুছে নিন, জোরে ঘষা দেবেন না। ত্বক সামান্য ভেজা থাকতেই ময়েশ্চারাইজার লাগান।
* ক্ষত ও আঘাত থেকে বাঁচুন
ডায়াবেটিস রোগীদের ত্বক খুবই সংবেদনশীল। ছোটখাটো আঘাত বা ক্ষতও গুরুতর হতে পারে।
পরামর্শ : জুতা পরার আগে ভেতরে কোনো কিছু আছে কি না দেখে নিন। ধারালো কিছু ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। কোনো ক্ষত হলে দেরি না করে অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করে ঢেকে রাখুন এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন।
* রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ
ত্বককে সুস্থ রাখার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো আপনার ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
উপায় : আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা করুন এবং ওষুধ/ইনসুলিন গ্রহণ করুন। HbA1C মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে ত্বকের সংক্রমণ ও সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। উচ্চ রক্তশর্করা ত্বকের শুষ্কতা এবং সংক্রমণকে বাড়িয়ে তোলে।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন
পর্যাপ্ত পানি পান করুন। পানি ত্বককে ভেতর থেকে আর্দ্র রাখে। খাদ্যতালিকায় ফল, সবজি ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (যেমন: মাছ, বাদাম) যোগ করুন। এগুলো ত্বকের কোষের পুনর্গঠনে সাহায্য করে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় পরিহার করুন।
পোশাক : শীতকালে সুতির আরামদায়ক পোশাক পরুন। আঁটোসাঁটো পোশাক এড়িয়ে চলুন, যা ত্বকে ঘষা লেগে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।
* কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
ত্বকের সাধারণ যত্ন এবং ছোটখাটো সমস্যার সমাধান আপনি নিজেই করতে পারবেন। কিন্তু কিছু লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত একজন ত্বক বিশেষজ্ঞ বা আপনার ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য। যেমন—
— ত্বকের কোনো ক্ষত বা ফোড়া দু-তিন দিনের মধ্যে না সেরে লালচে ভাব, ব্যথা, ফোলা বা পুঁজ বের হওয়া বাড়লে।
— ত্বকের কোনো অংশে অতিরিক্ত চুলকানি হলে এবং ঘরোয়া উপায়ে তা না কমলে।
— ছত্রাক সংক্রমণের লক্ষণ (যেমন: সাদা প্রলেপ বা অতিরিক্ত লালচে ফুসকুড়ি) দেখা দিলে এবং সাধারণ অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিমেও উন্নতি না হলে।
— ত্বকের সংক্রমণের সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বা জ্বর এলে।
— পায়ের কোনো অংশে সংবেদনশীলতা কমে গেলে বা কালো দাগ দেখা দিলে (যা গ্যাংগ্রিনের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে)।
শেষকথা
বলা যায়, ডায়াবেটিস রোগীদের ত্বকের যত্ন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। শীতকালে এর গুরুত্ব আরো বাড়ে। নিয়মিত রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রেখে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে এবং নিয়মিত ত্বক ময়েশ্চারাইজ করে আপনি শুধু ত্বক নয়, আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যও ভালো রাখতে পারবেন। নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি সামান্য সচেতনতাই আপনাকে শীতকালে সুস্থ ও সতেজ রাখতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন), বারডেম জেনারেল হাসপাতাল
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজথেরাপি চিকিৎসা
বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়