আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

খোলাফায়ে রাশেদিনের রাষ্ট্র পরিচালনার বুনিয়াদ

মাহমুদ আহমাদ

খোলাফায়ে রাশেদিনের রাষ্ট্র পরিচালনার বুনিয়াদ

নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খেলাফত রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেন খুলাফায়ে রাশেদিন। পারিভাষিকভাবে খুলাফায়ে রাশেদিন অর্থ চারজন নীতিবান ও সুপথপ্রাপ্ত সাহাবীর শাসন— আবু বকর সিদ্দিক, ওমর ফারুক, ওসমান গনী এবং আলী ইবনু আবু তালিব (রা.)। আবু বকর সিদ্দিকের মাধ্যমে খুলাফায়ে রাশেদিনের শাসন শুরু হয়। শেষ হয় আলী ইবনু আবু তালিবের ইন্তেকালের মাধ্যমে। তাদের শাসনকাল ছিল ৩০ বছর। ৬৩২-৬৬১ খ্রিস্টাব্দ।

বিজ্ঞাপন

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আমার সুন্নত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদিনের রীতিনীতি আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাঁত দিয়ে মজবুত করে ধরে রাখবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৭১৪৫)

তাদের যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল দ্বীনের ওপর অবিচলতা। শাসনব্যবস্থার মজবুত ভিত্তির ওপর নির্ভরতা। ফলে তাদের শাসনকালে এক আলোকিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সে আলোয় আলোকিত হয়েছিল সমগ্র মানবজাতি।

খিলাফতে রাশেদার সম্পূর্ণ শাসনকাল ছিল মজবুত বুনিয়াদ ও সুনির্দিষ্ট মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো—

প্রথম বুনিয়াদ : শূরাব্যবস্থা

রাষ্ট্র, সমাজ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এবং যোগ্য ব্যক্তিদের পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিনির্ভর প্রক্রিয়াকে শূরা বলা হয়। খুলাফায়ে রাশেদিনের সার্বিক কার্যক্রমে শূরাব্যবস্থার প্রতিফলন সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক—

এক : খলিফা নির্বাচন ও খিলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তর

শূরার ভিত্তিতেই খুলাফায়ে রাশেদিন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাদের শাসনের প্রতিটি ক্ষেত্র ও পর্যায়ে শূরাব্যবস্থা কার্যকর ছিল। আবু বকর (রা.) যখন আনসার ও মুহাজির সাহাবিদের সম্মিলিত মতের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচিত হন, তখন এর সূচনা হয়। (আল ইবানাহ ফি উসুলিদ দিয়ানাহ, আবুল হাসান আশআরি, পৃষ্ঠা : ৬৬)

মৃত্যুর আগে আবু বকর (রা.) বিশিষ্ট সাহাবির সঙ্গে পরামর্শ করে অর্থাৎ শূরার ভিত্তিতে পরবর্তী শাসক হিসেবে উমর (রা.)-কে মনোনীত করেন। তিনি সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মুখে উমরের প্রশংসা শোনেন, তার প্রতি সন্তুষ্টি লক্ষ্য করেন। তাই তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। (তাবাকাতু ইবনি সাদ, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১৯৯)

উসমান (রা.) দুই ধাপে খলিফা নির্বাচিত হন। প্রথমপর্যায়ে তিনি উমর (রা.) নির্ধারিত খলিফা হওয়ার উপযুক্ত ছয়জনের একজন ছিলেন। দ্বিতীয়পর্যায়ে খলিফা নির্বাচনের বিষয়ে মদিনার সব সাহাবির মধ্যে একাধিক পরামর্শ সভা বা শূরা মজলিশ অনুষ্ঠিত হয়, এর পরপরই সাধারণ জনগণ তার হাতে খিলাফতের বায়াত গ্রহন করে। (ফাতহুল বারি, খণ্ড : ১৩, পৃষ্ঠা : ১৯৩)

আলি (রা.)-এর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছিল। অল্পসংখ্যক শুধু উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কিসাস কার্যকর করার প্রশ্নে তার সঙ্গে মতভেদ করেছিল। তবে তাদের বিরোধিতা আলি (রা.)-এর খিলাফতের যোগ্যতা বা অধিকার নিয়ে নয়, ছিল বিচারের দাবিতে । কাজেই আমরা দেখতে পাই, শূরার মাধ্যমে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরই ছিল খুলাফায়ে রাশেদিন যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

দুই. শাসনের সব বিষয়ে শূরার কার্যকর প্রয়োগ

যেসব বিষয়ে কোরআন ও সুন্নাহতে সরাসরি কোনো নির্দেশনা পাওয়া যেত না, সেসব ক্ষেত্রে খলিফারা শূরার ওপর নির্ভর করতেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তাদের কার্যাবলি তাদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে।’ (সুরা শুরা, আয়াত : ৩৮)

এই নীতির সফল প্রয়োগের মাধ্যমে তারা পরবর্তী যুগের চেয়ে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই; কারণ শূরাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে, জনগণকে শাসনে অংশগ্রহণ ও শাসকের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়, উম্মাহর কল্যাণ করে এবং তা সুরক্ষিত রাখে। শূরাভিত্তিক শাসনের সূচনা করেছিলেন আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি সঠিক কাজ করি, তবে আমার সহযোগিতা করবে; আর যদি ভুল করি, তবে আমাকে সংশোধন করে দেবে।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৬৬)

দ্বিতীয় বুনিয়াদ : ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা

এটি মূলত দুটি ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল—

এক. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনের বিন্যাস

খুলাফায়ে রাশেদিন প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন অঞ্চলকে সংগঠিত করেন এবং কাজের জন্য সর্বাধিক যোগ্য, উপযুক্ত ও সক্ষম ব্যক্তিদেরই গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। উমর (রা.) জনতার উদ্দেশে এক ভাষণে গভর্নরদের দায়িত্ব নির্ধারণ করে বলেছিলেন—‘লোকসকল! আমি আমার এই গভর্নরদের তোমাদের কাছে ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে পাঠিয়েছি। তোমাদের দেহ, রক্ত কিংবা সম্পদের সবকিছু গ্রহণ করার জন্য আমি তাদের নিয়োগ দিইনি; বরং তোমাদের দ্বীনের বিধান ও সুন্নাহ শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি তাদের পাঠিয়েছি।’ (মানাকিবু উমর, ইবনুল জাওজি, পৃষ্ঠা : ৯৪)

খুলাফায়ে রাশেদিনের পাঠানো গভর্নররা বিভিন্ন শহর-নগর প্রতিষ্ঠা ও সমাজ-সভ্যতা বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন—উন্নতি ও সমৃদ্ধির মাধ্যমে যেগুলো পরবর্তীকালে বৈশ্বিক নগরীতে পরিণত হয়েছিল। তারা শহরের অবকাঠামোগত বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, সেতু নির্মাণ করেন, খাল খনন করেন এবং যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলেন মানবসভ্যতা বিনির্মাণের দিকপাল, যা শরিয়তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত। (তারিখে তাবারি, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ১৪৭-১৪৮)

দুই : বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার ও বিচারিক স্বাধীনতা

খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে বিচারব্যবস্থা ছিল শরিয়তের বিধান বাস্তবায়নের এক উজ্জ্বল ক্ষেত্র। সে সময় বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছিল এবং তা ছিল ন্যায়পরায়ণতা ও সততার প্রতীক। বিচার-সংক্রান্ত বিবিধ বিষয়ে গভর্নরদের কাছে পাঠানো উমর (রা.)-এর পত্রগুলো যুগে যুগে অনুসরণযোগ্য সংবিধানে পরিণত হয়েছে।

আলি (রা.) বসরার গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কাছে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে আল্লাহতায়ালার তাকওয়া অবলম্বনের উপদেশ দিচ্ছি। আল্লাহ যাদের দায়িত্ব তোমার ওপর অর্পণ করেছেন, তাদের সঙ্গে ন্যায়্যানুগ আচরণ করার নির্দেশ দিচ্ছি। মানুষের প্রতি তোমার মুখভঙ্গি, জ্ঞান ও শাসনের মাধ্যমে উদার হও।’ (আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ইবনে কুতাইবা দিনাওয়ারি, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৭৯)

খিলাফতে রাশেদার যুগে বিচারব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ও রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। সেখানে রায়ে হস্তক্ষেপ বা পক্ষপাতিত্বের কোনো সুযোগ ছিল না। বাদী ও বিবাদী—যেই হোক না কেন—সবাই আইনের দৃষ্টিতে সমান ছিল, এমনকি খলিফা ও গভর্নররাও আইনের কাছে দায়বদ্ধ ছিল।

তৃতীয় বুনিয়াদ : নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে খুলাফায়ে রাশেদিন সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে অপরিহার্য নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে; তবে এখানে নিরাপত্তার একটি দিক—ফিকরি নিরাপত্তা—নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

ইসলামের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে কুফর শিরকের বিভ্রান্তি ও চিন্তাগত বিচ্যুতির অন্ধকার থেকে মুক্তিদান করেন এবং মানুষের দ্বীন ও ফিকরের সুরক্ষার জন্য বহু বিধান ও আইন প্রণয়ন করেন। নবী (সা.)-এর পথ অনুসরণ করে খলিফারা মানুষকে দ্বীনের দিকে আহ্বান জানাতে বিভিন্ন দিকে দূত প্রেরণ করেন, দ্বীন শেখানোর জন্য শিক্ষক পাঠান, তাদের নামাজে ইমামতি ও অন্যান্য দায়িত্ব অর্পণ করেন। প্রথমে ব্যাখ্যা ও স্পষ্টীকরণের মাধ্যমে, তারপর কার্য-কারণগুলো অপসারণের মাধ্যমে তারা বিদআত ও বিকৃত চিন্তাধারার মোকাবিলা করেন।

আবু বকর (রা.) রিদ্দাহ বা ধর্মত্যাগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এটা ছিল মুসলিম সমাজের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলাকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া গুরুতর সংকটগুলোর একটি। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এর মোকাবিলা করেন এবং মুসলিম রাষ্ট্রের ছায়ায় মানুষ নিজেদের আকিদা বিশ্বাস, জীবন, সম্পদ ও সম্মান নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারে, তা নিশ্চিত করেন। (আল কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আসির, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২৭; মুকাদ্দামা, ইবনে খালদুন, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৮৫৯)

চতুর্থ বুনিয়াদ : ন্যায়বিচার

খুলাফায়ে রাশেদিন কথা ও কাজে ন্যায়বিচারের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। জনগণের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তারা এর ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন এবং তা কঠোরভাবে প্রয়োগে করতে তিনি গভর্নরদের বাধ্য করেছেন। খিলাফতে রাশেদার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে; এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো—

এক. মুসলিমদের জন্য ন্যায়বিচারের সর্বজনীনতা

সব মুসলিমের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারা সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। উত্তম চরিত্র ও সুনামের অধিকারী গভর্নর নির্বাচন, জনগণের ওপর অন্যায় কর্তৃত্ব আরোপে নিষেধাজ্ঞা, তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং সীমালঙ্ঘন করলে জবাবদিহির মাধ্যমে তারা ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

দুই. অমুসলিম ও চুক্তিবদ্ধ জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার

কোনো এক যুদ্ধক্ষেত্রে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আহলে কিতাব অর্থাৎ আসমানি কিতাবের অনুসারীদের সঙ্গে সংযম অবলম্বনের নির্দেশ দেন এবং সেনাপতিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে, যারা একান্তভাবে নিজেদের উপাসনালয়ে অবস্থান করে, তাদের (আক্রমণ বা হত্যা না করে) তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেবে।’ (তারিখে তাবারি, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২২৭)

উসমান (রা.) চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমদের প্রতি জুলুম ও অবিচার সম্পর্কে কঠোর সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘সতর্ক থাকো, সতর্ক থাকো—ইয়াতিম ও চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তির প্রতি জুলুম করো না; কারণ আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুমকারীর প্রতিপক্ষ।’ (তারিখে তাবারি, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৫৯১)

তিন. মুসলিম দেশে বসবাসরত অমুসলিমদের (আহলে জিম্মাহ) সঙ্গে ন্যায়বিচার

খিলাফতে রাশেদার যুগে আহলে জিম্মারাও ন্যায়বিচারের আওতাভুক্ত ছিল। এ বিষয়ে বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আলি (রা.) বনু নাজিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠানো সময় মাকাল ইবনু ইয়াসারকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘কিবলামুখী মুসলমানদের সঙ্গে সীমালঙ্ঘন করো না এবং আহলে জিম্মাহর ওপর জুলুম করো না।’ (তারিখে তাবারি, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১৪৩)

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন