বুড়িগঙ্গায় ভাসমান হোটেল, ৪০ টাকায় রাতযাপন

জেলা প্রতিনিধি, ঢাকা
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ৫৫

রাজধানীতে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বুড়িগঙ্গার তীরে রয়েছে ভাসমান হোটেল। যেখানে ৪০ থেকে ১০০ টাকায় রাত কাটানো যায়। দিনমজুর, শ্রমিক, হকার ও ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ীরা এখানে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া রাজধানীতে আসার পর থাকার জায়গা না থাকলে তারাও বেছে নেন স্বল্প খরচের এই বোর্ডিং।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৬০ সালে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান বোর্ডিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। তখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা ঢাকায় আসতেন ব্যবসার কাজে। ঢাকায় থাকার হোটেলের সংখ্যা ছিল তখন খুবই কম।

মফস্বলের ব্যবসায়ীদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে ঢাকার কিছু ব্যবসায়ী মহাজন তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় তৈরি করেন ভাসমান বোর্ডিংগুলো।

নৌকার মধ্যে কাঠের বোর্ডিং তৈরি করা হয়। খাওয়ার পাশাপাশি থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়। খাওয়ার জন্য টাকা নিলেও থাকার জন্য টাকা নেওয়া হতো না । স্বাধীনতার পর থাকার জন্য টাকা নেওয়া শুরু হয়।

৯০-এর দশকের পরে সংস্কার করে লোহা দিয়ে তৈরি করা হয় বোর্ডিংগুলো। কয়েক বছর পর পর এই নৌকাগুলো ডক ইয়ার্ডে পাঠিয়ে সংস্কার ও মেরামত করা হয়ে থাকে।

পাকিস্তান আমল থেকে বোর্ডিংগুলো সদরঘাট এলাকায় থাকলেও লঞ্চ টার্মিনালের উন্নয়ন কাজের জন্য বিআইইডব্লিউটিএ’র নির্দেশে ২০২০ সালের শুরুতে এগুলো মিটফোর্ড ঘাটে স্থানান্তর করা হয়।

সরেজমিনে বুড়িগঙ্গার মিটফোর্ড ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, একটি কাঠের তৈরি ছোট এবং পাঁচটি লোহার তৈরি নৌযানে ভাসমান বোর্ডিং। এর মধ্যে কাঠের তৈরি বোর্ডিং ও লোহার তৈরি অপর একটি ভাসমান বোর্ডিং অনেকটাই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।

উমা উজালা, ফরিদপুর বোর্ডিং, শরীয়তপুর বোর্ডিং ও বুড়িগঙ্গা নামে চারটি ভাসমান বোর্ডিংয়ে রাত যাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। ভাসমান বোর্ডিংয়ে ওঠা-নামার জন্য পাড় থেকে রয়েছে বাঁশ ও কাঠের তৈরি সাঁকো। দ্বিতল বোর্ডিংগুলোতে নিচতলা ও দোতলায় দুপাশে সারিবদ্ধভাবে কক্ষ আর মাঝখান দিয়ে রাস্তা।

কোনোটায় রয়েছে অতিথিশালা। বোর্ডিংগুলোর প্রথম কক্ষেই থাকেন একজন ম্যানেজার। দুপাশের সারিতে রয়েছে এক সিট ও দুই সিটের কক্ষ, যা কেবিন নামে পরিচিত। রয়েছে উন্মুক্ত ঢালাই বিছানার কক্ষ। যেখানে ৩-৪ জন একসঙ্গে থাকেন নিজেদের কাঁথা-বালিশ নিয়ে। এভাবে থাকতে তাদের ভাড়া দিতে হয় জনপ্রতি মাত্র ৪০ টাকা।

এর বাইরে কেবিনগুলোতে রয়েছে তোশক, কাঁথা, বালিশ, ফ্যান ও লাইট। এক সিটের কেবিনে ভাড়া ১০০ টাকা। দুই সিটের কেবিনের ভাড়া দিন প্রতি ১৫০ টাকা। একেকটি ভাসমান বোর্ডিংয়ে ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বোর্ডিংগুলোতে থাকতে পারেন শুধু পুরুষরাই।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদরঘাট ও তার আশপাশের এলাকায় প্রচুর ভাসমান লোক রয়েছে। যারা নিম্নআয়ের লোক, কাজ করেন কিন্তু থাকার জায়গা নেই। আবার বেশি টাকা খরচ করে আবাসিক হোটেলে থাকার সামার্থ্যও নেই। তারাই থাকেন এই বোর্ডিংগুলোতে।

মালিকরা গ্রাহকদের সুবিধা মাথায় রেখে সে অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করেন। বোর্ডিংয়ে বিনামূল্যে কম্বল, পানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা রয়েছে।

বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ী আরমান জানান, তিনি সেখানে একটি ৮০ টাকার কক্ষে প্রায় ৯ মাস ধরে থাকছেন। এর আগে তিনি একটি আবাসিক ম্যাচে মাসে ২০০০ টাকায় ভাড়ায় থাকতেন।

তিনি বলেন, ভাসমান বোর্ডিংয়ে দৈনিক ভাড়ার ব্যবস্থা ও বিনামূল্যে পাওয়ার সুযোগ-সুবিধা তার জন্য বেশি লাভজনক।

কথা হয় বোর্ডিংয়ে অবস্থানকারী আমির হোসেনের সঙ্গে। কাজের উদ্দেশ্যে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন। তেমন কোনো কাছের আত্মীয় না থাকায় উঠেছেন বুড়িগঙ্গার ভাসমান বোর্ডিংয়ে । তিনি বলেন, থাকার মতো সব সুযোগ-সুবিধা এখানে রয়েছে। কিছু কিনতে হচ্ছে না। সবকিছু রেডি পেয়ে ব্যবহার করছি।

ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ মোস্তফা মিয়া বলেন, পাকিস্তান আমলে আমার মামা এই ব্যবসাটা করতেন। এখন মামার অবর্তমানে আমি করছি। এক সময় এখানে মানুষ বিনা পয়সায় থাকত।

শুধু রাতের খাবার হোটেলে খেলে ঢালা বিছানায় থাকা ফ্রি ছিল। এখন সবকিছুতে অনেক ব্যয় হয়। শুধু আইডি কার্ড দেখিয়ে যে কেউ থাকতে পারে। অনেকেই আছে মাসের পর মাস ধরে থাকে এখানে। জায়গা পরিবর্তনের কারণে কাস্টমার অনেক কমে গেছে। তবে আস্তে আস্তে ঠিক আগের মতো জমে উঠবে বলে আশা করেন তিনি।

শরীয়তপুর ভাসমান মুসলিম হোটেলের ম্যানেজার রমজান আলী বলেন, পাকিস্তান আমলে মেজর শফিউল সাহেব এসব ভাসমান হোটেলের লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এখন বিআইডব্লিউটিএ’র অধীনে আছে। সাধারণত ঘাটের শ্রমিক, হকার ও ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ীরাই এখানে থাকেন।

এছাড়াও সদরঘাটের নৌপথে যাতায়াতকারী দরিদ্র মানুষ এখানে রাতযাপন করেন। তবে ব্যবসার অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ। নিম্নআয়ের ব্যবসায়ী যাদের পরিবার থাকে গ্রামে, তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এসব হোটেল। এত অল্প টাকায় ঢাকা শহরে থাকার জন্য আর কিছু নেই। ভাসমান হোটেল প্রতিদিন রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। মানুষ বেশি হলে ছাদেও থাকার ব্যবস্থা আছে বলে জানান তিনি।

রাকিব হোসেন / সম্পাদনা : আলী হোসেন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত