বাংলাদেশের গর্ব রাজশাহী কলেজ

মঈন উদ্দিন, রাজশাহী
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ০৬: ২৫

উত্তরবঙ্গের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের গৌরবময় প্রতীক রাজশাহী কলেজ। ১৫২ বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আসছে দেশের অন্যতম প্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য লাল দালানে ঘেরা ক্যাম্পাসটি প্রথম দেখাতেই প্রাচীন কোনো রাজপ্রাসাদের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। তবে এটি কোনো রাজপ্রাসাদ নয়; বরং উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৭৩ সালের ১ এপ্রিল যাত্রা শুরু করা রাজশাহী কলেজ শুধু রাজশাহীর নয়, গোটা দেশের শিক্ষাঙ্গনে একটি গর্বের নাম। বহু সংগ্রাম আর সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রতিষ্ঠানটি অর্জন করেছে অসংখ্য সাফল্য ও স্বীকৃতি।

শুধু ভাষা আন্দোলন কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধ নয়, যে কোনো জাতীয় ও ছাত্র আন্দোলনে কলেজটির অবদান অপরিসীম। জাতীয় প্রয়োজনে প্রতিটি গণআন্দোলনে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্মরণীয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি সফল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে কলেজটি।

বিজ্ঞাপন

খরস্রোতা পদ্মার তীরঘেঁষে অবস্থিত কলেজটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পর বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে টানা চারবার দেশসেরা কলেজের স্বীকৃতি পেয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, প্রাচীন বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল ও রাজশাহী জিলা স্কুলের (বর্তমান কলেজিয়েট স্কুল) হাত ধরেই পথচলা শুরু রাজশাহী কলেজের। ১৮৭২ সালে দুবলহাটির রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর দানকৃত সম্পত্তি ও দীঘাপতিয়ার রাজা প্রমথনাথ রায়ের এক লাখ ৫০ হাজার টাকায় স্থাপিত হয় ভবনটি। ১৮৭৩ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহী জিলা স্কুলে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) শ্রেণি চালুর মাধ্যমে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় ১৮৭৮ সালে প্রথম গ্রেডের মর্যাদা পায় কলেজটি। রাজশাহী কলেজ নামকরণ হয় ওই সময়ই। একই বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর উত্তরবঙ্গের প্রথম কলেজ হিসেবে রাজশাহী কলেজেই চালু হয় বিএ কোর্স। কলেজে ১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স। ১৮৮৪ সালে নির্মাণ করা হয় কলেজের প্রথম ভবন (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন)।

১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। কলেজে আইকম, বিকম (পাস) এবং বিকম (সম্মান) কোর্স চালু হয় যথাক্রমে ১৯৫২, ১৯৫৪ এবং ১৯৬১ সালে। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমও।

কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন তৎকালীন রাজশাহী জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরগোবিন্দ সেন। এ ছাড়া সুদীর্ঘ পথচলায় অসংখ্য প্রথিতযশা ব্যক্তি শিক্ষকতা করেছেন কলেজটিতে। তাদের মধ্যে এফটি ডাউডিং, শ্রী কুমার ব্যানার্জী, বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. এনামুল হক, অধ্যাপক সুনীতি কুমার ভট্টাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম শামস উল হক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তি কলেজটিতে পড়াশোনা করেছেন। তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু, উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি স্যার যদুনাথ সরকার, শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ, মুক্তিবাহিনীর উপসর্বাধিনায়ক একে খন্দকার, ৬ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এম খাদেমুল বাশার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া, বৈজ্ঞানিক প্রথায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃৎ ও অন্যতম সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র, কথাসাহিত্যিক আনোয়ার পাশা, নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ, গল্পকার রফিকুর রশিদ, কলামিস্ট ড. এবনে গোলাম সামাদ উল্লেখযোগ্য।

এ ছাড়াও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে পাঠদান করা হতো। সে সময় অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও ওড়িশা থেকে অগণিত শিক্ষার্থী আসত জ্ঞানার্জনের জন্য। অবিভক্ত ভারতবর্ষে রাজশাহীর পরিচয়ই ছিল রাজশাহী কলেজের নামে।

পড়াশোনার পাশাপাশি কলেজটির প্রাচীন ভবনগুলো স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে রয়ে গেছে। চীনা কারিগর-মিস্ত্রিদের হস্তশিল্পের সমন্বয়ে ব্রিটিশ শৈলীতে কাঠের সানশেড দিয়ে নির্মিত এ কলেজের প্রশাসনিক ভবনটি এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। হাজী মুহম্মদ মুহসীন ভবন, ফুলার ভবন, প্রশাসনিক ভবনের মতো লালরঙা ভবনগুলো প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। ভবনগুলো আজও সে আমলের রাজকীয় স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয় বর্তমান প্রজন্মকে। সুরম্য স্থাপত্যশৈলী এখনো সগৌরবে কলেজটির ঐতিহাসিক পরিচয় ঘোষণা করে। ফলে রাজশাহী কলেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে লালরঙা ভবন, যা নীরবে পথচারীর মনোযোগ আকর্ষণ করে।

প্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছে একটি জাদুঘর বা সংগ্রহশালা। তবে এটি প্রায় শতবর্ষ ধরে তালাবদ্ধ বলে জানা গেছে। জাদুঘরটি রয়েছে একটি এক কক্ষবিশিষ্ট ঘরে, যা অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীই জানেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই জাদুঘরে আছে ব্রিটিশ আমলের আটটি ঘড়ি, তিনটি রেডিও ও আয়না, দুটি পুরস্কার মেডেল, ৩৪টি কাঠের ওপর ছাপা চিত্রকর্ম, দুটি মাইক্রোস্কোপ ও ছয়টি বিজ্ঞানযন্ত্র, দেশি-বিদেশি মনীষীদের প্রতিকৃতি, পুরোনো দলিল, প্রাচীন বই, ফাইল ও শিক্ষকদের অনার বোর্ড, কাঠের আলমারি, টেবিল ফ্যান, ঝাড়বাতি, আয়না এবং একটি প্রাচীন প্রিন্টিং মেশিন।

বর্তমানে কলেজটির প্রতিটি বিভাগকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগে চালু করা হয়েছে মালটিমিডিয়া ক্লাসরুম। শিক্ষকদের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ল্যাপটপ। গবেষণা আর তথ্যবিনিময়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগে দেওয়া হয়েছে ওয়াই-ফাই সেবা। কলেজটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রেণিকক্ষ, প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ ফটকগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে সিসি ক্যামেরায়। প্রায় তিন লাখ বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে রয়েছে বিশাল একটি গ্রন্থাগার, যেখানে রয়েছে পুরোনো দিনের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ছাড়াও নিত্যনতুন প্রয়োজনীয় বই। মুক্ত জ্ঞানার্জনের জন্য প্রতিদিনই সেখানে ভিড় জমান কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও অনেকে। কলেজটিতে আরো রয়েছে পাঁচ শতাধিক কম্পিউটারসংবলিত ‘ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব’। এ ছাড়া বিভিন্ন বিভাগেও আলাদা ল্যাব রয়েছে।

জানতে চাইলে কলেজটির উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম বলেন, দূর থেকে রাজশাহী কলেজকে ছোট একটি গল্প মনে হলেও এটি একটি মহাকাব্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছর কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে পৃথিবীর কল্যাণে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে কলেজের ইতিহাসের পাতা বাড়ে আর আমরা তা শুনে স্বস্তি পাই। ৩৫ একর আয়তনের এই লাল-সবুজের জগতে যখনই প্রবেশ করি, মনে হয় স্বর্গে প্রবেশ করছি। মনের সব বিষণ্ণতা, ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয় এখানে প্রবেশের মাধ্যমে।

কলেজটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী রইসুল ইসলাম বলেন, কলেজে যে জাদুঘর আছে, তা সম্পর্কে আমি জানি না। অন্য এক শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রাজশাহী কলেজে পড়তে পেরে আমি গৌরববোধ করি। শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, মনিটরিং, নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া, সর্বোপরি কলেজের শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের জন্য কলেজটি বারবার সেরা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, কলেজটির দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্তা পদ্মা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোলঘেঁষে রয়েছে হজরত শাহ মখদুম (রহ.)-এর মাজার, সঙ্গে কলেজটির লাল ভবন দর্শনার্থীর মন জয় করতে ভূমিকা রাখে।

রাজশাহী কলেজের পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা কলেজটিকে শিক্ষা ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে গণ্য করেন। তারা কলেজটিকে শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং গর্বের বিষয় হিসেবে দেখেন। স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাজশাহী কলেজ শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান, যা শহরের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তিনি বলেন, কলেজটির প্রতিবেশী হয়ে আমরা গর্বিত।

কলেজটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক দিপক সরকার বলেন, বরেন্দ্রভূমিতে রাজশাহী কলেজ আশীর্বাদস্বরূপ। এক সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায়ের পড়াশোনা হতো। বাংলাদেশে এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, ফিকে হয়েছে রাজশাহী কলেজ। তবে শেষ হয়ে যায়নি। শিক্ষা খাতে সগৌরবে অবদান রাখছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দেশসেরা হয়েছে বারবার।

উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ইব্রাহিম আলী বলেন, রাজশাহী কলেজ ইতিহাস-ঐতিহ্যের আধার। দীর্ঘ ১৫২ বছর ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আমাদের কলেজে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস করা বাধ্যতামূলক। পড়াশোনার পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে অবারিত সুযোগ। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সাংবাদিকতাসহ সব ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসের যথেষ্ট সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা সর্বদা সচেষ্ট। ক্যাম্পাসের ওয়াশরুম থেকে শুরু করে মাঠচত্বরÑসবকিছুই পরিপাটি। তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায়ে আমরা বারবার টপ করছি। আমাদের প্রত্যাশা ও প্রচেষ্টায় জায়গায় আমরা সফলতার নজির রাখছি। আগামী দিনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমি আশাবাদী।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত