সাইগা হরিণ—নামটিই যেন শুষ্ক তৃণভূমির বাতাসে ভেসে আসা কোনো হারানো কবিতা। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীর উত্তরভাগ যখন বরফে ঢাকা, তখন থেকেই সাইগা হরিণ ইউরেশিয়ার বিস্তৃত প্রান্তরে ছুটে বেড়াত । একসময় এরা লাখ লাখ ছিল । আজ তারা ধুলোয় ঢাকা ইতিহাসের পাতায় নিঃশব্দ ছায়া মাত্র।
সাইগার শরীরটিকে প্রথম দেখলে মনে হয় কোনো জাদুকরী প্রাণী—অস্বাভাবিকভাবে নরম ও ঝুলে থাকা একধরনের নাক, যা শীতে বাতাসকে উষ্ণ করে তোলে আর গ্রীষ্মে ধুলোর তাণ্ডব ঠেকায়। বরফযুগের আবহাওয়ায় অভিযোজনের এই আশ্চর্য দৃষ্টান্ত যেন প্রকৃতির এক অতুলনীয় সৃষ্টি। পুরুষ সাইগার কপালে দুটো সামান্য বাঁকানো, হালকা রঙের শিং; শরীর তুলনামূলক ছোট, ছিপছিপে ও হরিণজাতীয় গঠন। গ্রীষ্মকালে শরীরের রঙ হয় হালকা বাদামি, শীতের শুরুতেই তাদের গায়ে ঘন সাদা পশমের কোট নামে ।
একসময় সাইগা হরিণ ইউক্রেন থেকে শুরু করে রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান, এমনকি চীনের উত্তরভাগ পর্যন্ত দেখা যেত । আজ মূলত তারা কাজাখস্তানের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে । যেখান থেকে ক্রমেই তাদের বিস্তৃতি হটে আসছে । মানুষের দখলদারি, কৃষি সম্প্রসারণ, শিকার, আবাসভূমির বিলুপ্তি এবং জলবায়ুর চূড়ান্ত পরিবর্তনের ফলে তাদের অস্তিত্ব এখন সংকটের একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিপর্যয় এসেছিল ২০১৫ সালে, যখন কাজাখস্তানে মাত্র কয়েক সপ্তাহে এক অজানা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণে প্রায় দুই লাখ সাইগা হরিণের মৃত্যু হয়েছিল। গবেষকরা জানান, আবহাওয়ার চরমতা ও আর্দ্রতা ওই ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারকে সহায়ক করে তোলে। এটি যেন প্রকৃতি নিজেই তার আহত বুকের রক্ত ঝরিয়েছিল।
চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধে সাইগার শিংয়ের চাহিদা তাদের জীবনকে আরো অনিরাপদ করে তুলেছে। চোরা শিকারিদের গুলি আর ধাতব ফাঁদের শিকার হয় অসংখ্য নিরীহ প্রাণী। আধুনিক রাস্তা, রেললাইন, তারকাঁটায় বাঁধা ফেন্সিং—সব মিলে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে তাদের চলার পথ। তারা আর একত্রে দৌড়াতে পারে না, প্রাচীন কাব্যের মতো গর্জন করে দলবদ্ধভাবে হেঁটে যেতে পারে না প্রান্তরের বুকে।
তবে সব অন্ধকারের মধ্যেও আশার প্রদীপ জ্বলে। কাজাখস্তান সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন WWF ও Saiga Conservation Alliance নানা সংরক্ষণমূলক উদ্যোগ নিচ্ছে। সুরক্ষিত অভয়ারণ্য তৈরি, চোরাশিকার রোধ, ড্রোন পাহারা, জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কিছু সাফল্য মিলেছে।
সর্বশেষ হিসাবে কাজাখস্তানে সাইগার সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, যা সংকটের পরও একটি আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সাইগা হরিণ পৃথিবীতে এসেছে প্রায় ২০ লাখ বছর আগে। তারা বরফযুগের প্রতিচ্ছবি, গুহাচিত্রে আঁকা প্রাচীন মানুষের কল্পনার প্রতীক। তারা আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধ।
আজও কোনো নির্জন রাতে, তৃণভূমির বাতাসে কান পাতলে শোনা যায়, হয়তো দূরে কোথাও একঝাঁক সাইগা হরিণ দৌড়াচ্ছে। তারা যেন বলছে—‘তোমরা চাইলে আমরাও বাঁচতে পারি। তোমরা চাইলে আবার গড়তে পারো সেই পৃথিবী, যেখানে জীবন শুধু অস্তিত্বের লড়াই নয়, বরং নিঃশব্দ সৌন্দর্যের গৌরব।’

