বেদনার ক্যানভাসে সামির

রেজাউল করিম খোকন
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ১২: ০৪

পুরো বাসাটি মাতিয়ে রাখত সে একাই। স্কুল থেকে ফিরেই নিজের খেলনাগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কিছুক্ষণ খেলনাগুলো নিয়ে সময় কাটানোর পর হাতমুখ ধুয়ে মায়ের হাতে মাখানো ভাত খেতে খেতে স্কুলের কত কী গল্প করত। সেই খেলনাগুলো তার পড়ার টেবিলে এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তার পড়ার বই ও খেলনাগুলোর দিকে তাকিয়ে এখন মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বিশাল এক শূন্যতার সঙ্গে সঙ্গে বিষাদের কালো ছায়া ভর করছে পুরো বাসায়। বুকের মধ্যে একরাশ বেদনা ভারী পাথরের মতো চেপে বসে। একমাত্র সন্তান সামির ছিল বাবা-মায়ের নয়নের মণি।

বিজ্ঞাপন

বাবা সাধারণ একজন চাকরিজীবী। তাদের সঙ্গে সামিরের চাচা মশিউরও থাকে, কলেজে পড়ে। সামান্য আয়ের সংসারটিতে বিত্তবৈভব না থাকলেও সুখের কমতি ছিল না। আর ছিল অনেক স্বপ্ন। সব স্বপ্ন ছিল সামিরকে ঘিরে। বাসায় যে ঘরটিতে সে পড়ত, সেখানে পড়ার টেবিলজুড়ে ছড়িয়ে আছে স্কুলের পাঠ্যবই, খাতা ও কলম-পেন্সিল। একপাশে র‌্যাকে সাজানো রয়েছে বই-খাতা ও গল্পের বই। ঘরের দেয়ালে বেশ কয়েকটি ছবি সাঁটানো আছে। সব ছবিই তার আঁকা। বাংলাদেশের পতাকা, নিজের স্কুলের ছবি, গ্রামের সবুজ ধানক্ষেত, নদীতে পালতোলা নৌকা—রঙিন ছবিগুলো উজ্জ্বল ঝলমলে।

১৯ জুলাই, ২০২৪। সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল গোটা দেশ। আরো আগে থেকেই দমন-পীড়ন ও নির্যাতনে গোটা দেশটাকে নরকে পরিণত করেছে স্বৈরাচারী সরকার। পুলিশ, র‌্যাব ও বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলন দমাতে হিংস্র হায়েনার মতো অস্ত্রহাতে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সন্ত্রাসীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছে সাধারণ মানুষ। সেই উত্তাল ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে স্বৈরাচারী সরকার হিংস্র ও পাশবিক হয়ে উঠেছে ক্রমেই। নির্বিচারে গুলি করেছে এবং সাউন্ড গ্রেনেড মেরে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তাদের মানবতাবিরোধী, হিংস্র ও পাশবিক আচরণে বিক্ষুব্ধ সবাই।

তাই ভয়কে জয় করে মৃত্যুর পরোয়া না করে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির উদ্যত অস্ত্রের সামনে বুক পেতে দাঁড়াতে মানুষ দ্বিধা করছে না। স্বৈরাচারের অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে জেগে উঠেছে গোটা বাংলাদেশ। রংপুরে বেগম রোকেয়া হিংস্র হায়েনার রূপ ধরে ঝাঁপিয়ে পড়া আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ বাহিনীর হুংকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পিছিয়ে কিংবা পালিয়ে না গিয়ে মুখোমুখি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিচলিত কিংবা ভীত না হয়ে বুক চিতিয়ে সেই উদ্যত অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়েছে। অবাক ব্যাপার, স্বৈরাচারী সরকারের নির্দেশ পালন করতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে এক মুহূর্ত দেরি করেনি। পুলিশের গুলি নির্ভীক দুঃসাহসী সেই যুবক আবু সাঈদের বুক বিদীর্ণ করেছে। দেশের পুলিশ বাহিনী এভাবে নিজ দেশের ছাত্রজনতার প্রতি গুলিবর্ষণ করবে, এটা যেন সে বিশ্বাস করতে পারেনি। একইভাবে মুগ্ধ, ফারহানসহ আরো বহু টগবগে তরুণ, যুবক ও কিশোর রাজপথে আত্মাহুতি দিয়েছে।

টেলিভিশনে বাবা-মা ও চাচার মোবাইলে ফেসবুক ও ইউটিউবে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর নৃশংসতার চিত্র দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠেছে সামির। মাত্র ১১ বছর বয়স তার। ক্লাস ফাইভে পড়ে সে। এই বয়সে তার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিকমতো বোঝার কথা নয়। কিন্তু বেশ কিছুদিনে চারপাশে যা ঘটছে, তা দেখে আঁতকে উঠছে বারবার। রাস্তায় মিছিল, স্লোগান ও হট্টগোল হচ্ছে। সঙ্গে পুলিশ ও র‌্যাবের গাড়ির সাইরেনের শব্দ। সব মিলিয়ে ছোট-বড় সবার মধ্যে আতঙ্ক ও ভয় বাসা বেঁধেছে। বেশ কিছুদিন ধরে সামিরের স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে বাসার কাছেই মায়ের সঙ্গে কোচিং করতে গিয়ে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের ধাওয়া ও গন্ডগোলের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে তার বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আজকাল ক্রিকেট ও ফুটবল খেলতে কোয়াটারের মাঠেও যাওয়া হয় না সামিরের। কিছুই ভালো লাগে না তার। ঘরের মধ্যে এভাবে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে যেন। বাসার কাছের রাস্তা দিয়ে যখন মিছিলগুলো যায়, স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় চারপাশ। আকাশ-বাতাসে অদ্ভুত এক শিহরন ছড়িয়ে পড়ে। তখন সামিরের মনেও প্রচণ্ড ইচ্ছে জাগে সেই মিছিলে গিয়ে যোগ দেয়, সবার সঙ্গে পা মিলিয়ে এগিয়ে যায়, মিছিলে অন্য সবার সঙ্গে স্লোগানে গলা মেলায়, উচ্চকিত হয় এবং নিজেকে তাদের একজন ভাবতে থাকে।

হঠাৎ করেই সামিরদের কোয়াটারের আশপাশে গোলাগুলি শুরু হয়। গুড়–ম গুড়–ম করে লাগাতার গুলি বর্ষিত হচ্ছে। টিয়ার শেল ছোড়া হয়েছে বেশ কয়েকটি, তার ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে এলাকাজুড়ে। ঘরের মধ্যে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছে। চোখ জ্বালা করছে। সামিরের চাচা মশিউর দ্রুত ছুটে যায় জানালার দিকে। ওটা বন্ধ করা তার উদ্দেশ্য। চাচার পেছনে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে কোথায় কী হচ্ছে দেখার জন্য কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে সামির । তখনই আচমকা একটি গুলি এসে মশিউরের কাঁধ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ব্যথায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করে পেছনে ফিরতেই সে দেখে, তার কাঁধে আঘাত করে বাইরে থেকে ছুটে আসা বুলেট সামিরের ডান চোখ আর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গিয়ে ঘরের দেয়ালে আঘাত করেছে। দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ে ইট বেরিয়ে এসেছে। গুলির আঘাতে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে ঘরের মধ্যে লুটিয়ে পড়েছে সামির। ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার পর সে ছটফট করতে থাকে। বাইরে থেকে ছুটে আসা তীব্র গতির বুলেটের আঘাত সব সম্ভাবনার আলো নিমিষেই নিভিয়ে দিয়েছে।

এখনো সেই ঘরটির দেয়ালে লেগে আছে রক্তচিহ্ন, পড়ার টেবিলে বইখাতা ও খেলনা। দেয়ালে ছোট্ট কিশোর সামিরের হাতের লেখা ও আঁকা ছবি। এরকম আরো কত কী ছড়িয়ে আছে ঘরজুড়ে। এখন সেগুলো সামিরের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না সে। বেদনার ক্যানভাসে সামিরের ছবিটি ঠাঁই পেয়েছে। এখন সুনসান নীরবতা তিন রুমের বাসাটিতে। যারা বাসায় আছেন তারা হাঁটাচলা ও কাজকর্ম করছেন, প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলছেন। সবকিছুই আগের মতো রয়েছে। কিন্তু তারপরও যেন বিশাল এক শূন্যতা গ্রাস করেছে বাসাজুড়ে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত