Ad T1

পডকাস্ট কালচারের উত্থান

আরিফ বিন নজরুল
প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১১: ১১

প্রচণ্ড যানজটে আটকে থাকা এক তরুণ। কানে ইয়ারফোন গুঁজে কোনো এক অজানা ভুবনে হারিয়ে গেছেন। রান্নাঘরে ভুনা খিচুড়ির ঘ্রাণের সঙ্গে মিশে আছে এক গৃহিণীর পছন্দের গল্পের পডকাস্ট। আবার রাজশাহীর এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, ক্লাসের বিরতিতে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী অডিও অনুষ্ঠান। এ যেন এক নীরব বিপ্লব—স্ক্রিনের ক্লান্তি থেকে মুক্তি দিয়ে কণ্ঠস্বরের সুরে ভেসে চলার বিপ্লব। এ বিপ্লবের নাম পডকাস্ট। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের ডিজিটাল দুনিয়ায় পডকাস্ট ছিল প্রায় অচেনা শব্দ। অডিও কনটেন্ট বলতে মানুষের মনে ভেসে আসত রেডিওর সুরেলা দিনগুলোর স্মৃতি। কিন্তু সময় বদলেছে। ইন্টারনেট এখন শহর থেকে গ্রাম, মফস্বল থেকে চরাঞ্চল—সবখানে পৌঁছে গেছে। স্মার্টফোন হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের সঙ্গী। আর এ সুযোগেই নীরবে মাথা তুলেছে নতুন এক মাধ্যম—পডকাস্ট। চোখের ওপর চাপ না দিয়ে, হাতের কাজ বন্ধ না করে, মানুষ এখন শুনে চলছে গল্প, বিশ্লেষণ, ইতিহাস কিংবা প্রযুক্তির হালনাগাদ।

শুরুর দিকে পডকাস্ট নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন কিছু উদ্যমী তরুণ-তরুণী। হাতে মাইক্রোফোন নয়; বরং ফোনের রেকর্ডারে গলা মিলিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের যাত্রা। ‘2 Cents Podcast’, ‘Golpokotha’, ‘SAFARNAMA’, ‘Cha’er Adda’, ‘Cafe Bazar’ এ রকম নানা নামের পডকাস্টগুলো ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশের অডিওপ্রেমী শ্রোতাদের হৃদয়ে। তাদের বিষয়ভিত্তিক বৈচিত্র্যও ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ বলতেন গল্পের ভেতরের গল্প। কেউবা ভেঙে দিতেন কঠিন বিজ্ঞান কিংবা ইতিহাসকে সহজ কথায়। একটু একটু করে বাংলা পডকাস্ট হয়ে উঠেছে মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়ার এক নতুন মাধ্যম।

পডকাস্টের উত্থানের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে দেশের দ্রুত সম্প্রসারিত ইন্টারনেট সুবিধা। অপটিক্যাল ফাইবারের জাল। ফোর-জি সংযোগের সহজলভ্য এবং স্মার্টফোনের সহজপ্রাপ্য যেন এই বিপ্লবের জন্য ছিল আদর্শ পটভূমি। এখন প্রায় সব বয়সের মানুষ কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেটে যুক্ত। আর স্ক্রিনের বাইরে গিয়ে কিছু শোনার প্রবণতা বাড়িয়েছে পডকাস্টের চাহিদা। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণসমাজ। যারা পড়ালেখার চাপের ফাঁকে বা কর্মজীবনের ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করে নিতে চান নিজেকে আরো একটু সমৃদ্ধ করার জন্য। তাদের কাছে পডকাস্ট হয়ে উঠেছে এক নির্ভরযোগ্য সঙ্গী।

শুধু বিনোদন বা ব্যক্তিগত সময় কাটানো নয়। পডকাস্ট এখন বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রেও জায়গা করে নিয়েছে। ইংরেজি শেখার জন্য পডকাস্ট। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পডকাস্ট। এমনকি মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়েও বিশেষায়িত পডকাস্ট পাওয়া যাচ্ছে এখন অনলাইনে। অডিও মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুবিধা হচ্ছে— কাজের ফাঁকে, যাত্রাপথে বা বিশ্রামের সময়ও শোনা যায়। চোখের ওপর বাড়তি কোনো চাপ পড়ে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ধীরে ধীরে পডকাস্ট ব্যবহার করতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক মাধ্যম হিসেবে।

পডকাস্ট নির্মাণের ক্ষেত্রেও বড় কোনো বাধা নেই। আজকের দিনে শুধু একটি স্মার্টফোন। ভালো ইন্টারনেট সংযোগ আর কিছুটা মনের আবেগ থাকলেই, একজন নির্মাতা তার নিজস্ব পডকাস্ট শুরু করতে পারেন। বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত Anchor, Spotify, Apple Podcasts, Google Podcasts-এর মতো প্ল্যাটফরম এখন বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল তরুণদের জন্যও উন্মুক্ত। কেউ চাইলে আজই নিজের কণ্ঠ দিয়ে নিজের চিন্তা বা গল্প বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়ে দিতে পারেন। বিনিয়োগকারীরাও এখন পডকাস্টকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। ব্র্যান্ডিং, স্পন্সরশিপ এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যদিও এই বাজার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পডকাস্টের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে অনেক উজ্জ্বল। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় পডকাস্ট নির্মাণের চেষ্টা চলছে। যাতে আরো বৃহৎ শ্রোতার কাছে পৌঁছানো যায়। পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ভিত্তিক পডকাস্ট, যেমন আত্মউন্নয়ন, মানসিক স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, রিমোট ওয়ার্কিং বা কৃষি উন্নয়ন। এসব দিকেও নির্মাতারা মনোযোগ দিচ্ছেন।

পডকাস্ট এখন আর শুধু একটি অডিও মাধ্যম নয়। এটি হয়ে উঠেছে গল্প বলার এক আধুনিক মাধ্যম। যেখানে কথা বলা হয়। শোনা হয়। অনুভব করা হয়। আর এভাবেই তৈরি হয় এক অদৃশ্য অথচ গভীর বন্ধন। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হোক বা গ্রামের ছায়াঢাকা উঠানে। একটা ছন্দিত কণ্ঠস্বর যখন শ্রোতার কানে বাজে, তখনই যেন বিশ্বটা ছোট হয়ে আসে। আর গল্পেরা ছড়িয়ে পড়ে আকাশের গায়ে।

বাংলাদেশে পডকাস্ট কালচারের এই উত্থান নিছক সময়ের দাবি নয়। এটি এক নতুন যুগের সূচনা। একটি শব্দমুগ্ধ প্রজন্মের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের ডিজিটাল অডিও বিপ্লব নীরবে, দুর্বার গতিতে ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত