বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। মতামত বিনিময়, তথ্য সংগ্রহ কিংবা বিনোদন—সব ক্ষেত্রেই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) দ্রুত বিকাশ সেই নির্ভরতার জায়গাটিকে নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
আজ সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে AI-নির্মিত ছবি, ভিডিও ও ভুয়া সংবাদ—যার বেশির ভাগই এতটাই নিখুঁত যে সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব।
এআইনির্মিত বিভ্রান্তির বিস্তার
AI-ভিত্তিক ‘ডিপফেইক’ প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির মুখ, কণ্ঠ বা আচরণ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে নকল করা যায়। কয়েক ক্লিকেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে এমন সব ছবি বা ভিডিও, যা কল্পনাও করা যায় না। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বক্তব্য, সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত মুহূর্ত, দুর্ঘটনার দৃশ্য বা যেকোনো সামাজিক ঘটনাবলির নাম করে এসব ছবি-ভিডিও প্রচারিত হয় এবং মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়ে। এদিকে ভুয়া নিউজপোর্টাল বা পেজগুলো AI ব্যবহার করে তৈরি ছবি-ভিডিওগুলো যাচাই-বাছাই না করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড দিচ্ছে। ফলে সাধারণ ব্যবহারকারী বিভ্রান্ত হয়, ভুল সিদ্ধান্ত নেয় এবং অনেক সময় অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি হয়।
কেন এসব সহজেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে?
১. বাস্তবের মতো দেখায়। আধুনিক AI ছবি ও ভিডিও এতটাই নিখুঁত যে, প্রথম দেখায় জালিয়াতি ধরা কঠিন।
২. অতিরিক্ত তথ্যপ্রবাহ। প্রতিদিন অসংখ্য পোস্ট, ভিডিও ও সংবাদ চোখে পড়ায় ব্যবহারকারী অনেক সময় যাচাই করার সময়ই পান না।
৩. মানুষের আবেগকে ব্যবহার করা হয়। যেসব বিষয় মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে, ভয়, ক্ষোভ, উত্তেজনা—AI সহজেই সেগুলোকে লক্ষ করে কনটেন্ট তৈরি করতে পারে।
৪. অ্যালগরিদমিক প্রভাব থাকে। সোশাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম বিতর্কিত ও আকর্ষণীয় পোস্টকেই বেশি দেখায়, যা বিভ্রান্তি আরো বাড়ায়।
সমাধান কোথায়?
AI-নির্মিত বিভ্রান্তির পুরোপুরি অবসান হয়তো একদিনে সম্ভব নয়, তবে সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত সতর্কতা এই আগ্রাসন মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারে।
১. ব্যক্তিগত পর্যায়ে সতর্কতা
তথ্যের উৎস যাচাই করুন, কোনো সংবাদ শেয়ার করার আগে উৎস কতটা নির্ভরযোগ্য, তা যাচাই করা জরুরি।
ছবি/ভিডিওর অস্বাভাবিকতা খুঁজুন। মুখের অদ্ভুত বিকৃতি, অপ্রাকৃতিক আলো, অসামঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গির মতো সূক্ষ্ম বিষয়গুলো ডিপফেইক ধরতে সাহায্য করে।
সন্দেহ হলে অন্য সূত্র দেখুন। একই ঘটনার খবর একাধিক পত্রিকা বা নির্ভরযোগ্য নিউজপোর্টালে আছে কি নাÑতা নিশ্চিত হন। শেয়ার করার আগে বিরতি নিন। উত্তেজনাপূর্ণ বা আবেগীয় বিষয় তৎক্ষণাৎ শেয়ার না করে একটু ভেবে দেখুন।
২. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা
AI-ডিটেকশন টুল উন্নত করা। বড় প্ল্যাটফর্মগুলোকে ডিপফেইক শনাক্তকারী উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে। ভুয়া সংবাদ শনাক্তে হিউম্যান মডারেশন বাড়ানো : স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের পাশাপাশি মানবসম্পৃক্ত পর্যবেক্ষণ ভুয়া কনটেন্ট ধরে ফেলতে বেশি কার্যকর।
বিভ্রান্তিকর কনটেন্টের লেবেলিং, সন্দেহজনক পোস্টের সতর্কীকরণ ট্যাগ ব্যবহারকারীদের সচেতন করে।
৩. গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষা। স্কুল-কলেজে ডিজিটাল সচেতনতার ওপর পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি। সাইবার আইন প্রয়োগ। ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর AI কনটেন্ট তৈরির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। জনসচেতনতা প্রচারণা। গণমাধ্যম ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যৌথভাবে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাতে হবে।
শেষ কথা
AI আমাদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে—কিন্তু সেই সম্ভাবনার সঙ্গে এসেছে ভয়ংকর অপব্যবহারের ঝুঁকি। সোশ্যাল মিডিয়ায় AI-এর আগ্রাসন ঠেকাতে হলে শুধু প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন দায়িত্বশীল ব্যবহারও। সচেতনতা ও সতর্কতা—এই দুই অস্ত্রই পারে ভুল তথ্যের জাল ছিন্ন করতে। সর্বোপরি কথা হচ্ছে—ডিজিটাল যুগে যে যত বেশি সচেতন, সে-ই তত বেশি নিরাপদ।

