আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিপফেকের ছড়াছড়ি

জুবাইর আল হাদী
নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিপফেকের ছড়াছড়ি

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তেমনি নতুন এক যুদ্ধ শুরু হয়েছে অনলাইনে। নির্বাচনি প্রচারণার বড় অংশ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আর এই ভার্চুয়াল মাঠেই ক্রমে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ডিপফেক প্রযুক্তি।

ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা টিকটকে চোখ বুলালেই দেখা যাচ্ছে, কোনো প্রার্থীর মুখে এমন বক্তব্য, যা তিনি কখনো বলেননি। কোথাও আবার প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আপত্তিকর মন্তব্য বা কর্মকাণ্ডে। এক দলের সমর্থকেরা অন্য দলের প্রার্থীকে ঘায়েল করতে ছড়াচ্ছে ভুয়া ভিডিও, বিকৃত অডিও ও মনগড়া ফটোকার্ড। সাধারণ ভোটারদের বড় অংশই বুঝে উঠতে পারছেন না—কোনটা সত্য, আর কোনটা নিখুঁতভাবে সাজানো মিথ্যা।

বিজ্ঞাপন

প্রযুক্তি যখন মিথ্যার কারখানা

ডিপফেক মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন এক প্রয়োগ, যেখানে ছবি, অডিও ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে কাউকে দিয়ে এমন কিছু করানো বা বলানো যায়, যা বাস্তবে ঘটেনি। ‘ডিপ’ ও ‘ফেক’ এই দুই শব্দের সমন্বয়েই নামটির অর্থ স্পষ্ট হয়ে ওঠে—গভীরভাবে তৈরি করা নকল। আধুনিক ডিপ লার্নিং অ্যালগরিদম, বিশেষ করে জেনারেটিভ অ্যাডভার্সারিয়াল নেটওয়ার্ক (জিএএন) ব্যবহার করে মানুষের মুখাবয়ব, কণ্ঠস্বর ও অভিব্যক্তি এমনভাবে বসিয়ে দেওয়া যায় যে সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না কোনো অসংগতি। শুরুতে এই প্রযুক্তি ছিল গবেষণা ও বিনোদনের খেলার জগতে সীমাবদ্ধ। সিনেমার দৃশ্যে ভিন্ন অভিনেতার মুখ বসিয়ে মজা করা, ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও বানানো—এসবেই সীমাবদ্ধ ছিল ব্যবহার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির হয়েছে সহজলভ্যতা আর ব্যবহারকারীদের বেড়েছে দক্ষতা। এখন অল্প কয়েকটি ছবি বা ছোট ভিডিও ক্লিপ দিয়েই তৈরি করা সম্ভব প্রায় নিখুঁত ডিপফেক।

নির্বাচন ও ডিপফেক

নির্বাচন মানেই একটা অন্যরকম আমেজ। এই মুহূর্তে ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে কোনো প্রার্থীকে উগ্র, চরিত্রহীন, অসৎ কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে তুলে ধরা হলে তার প্রভাব পড়ে সরাসরি ভোটারদের মনে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর নজির আছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ডিপফেক ভিডিও ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে আগেও। কোথাও সেনাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান, কোথাও ভুয়া স্বীকারোক্তি—সবই ছিল পরিকল্পিত বিভ্রান্তির অংশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও আশঙ্কা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক কনটেন্ট দ্রুত ছড়ায় এবং যাচাই করার মানসিকতা এখনো দুর্বল। ফলে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় এমন ভিডিও মুহূর্তের মধ্যেই হাজার হাজার শেয়ার পেয়ে যায়। পরে সত্য-মিথ্যা যাচাই হলেও ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়।

কীভাবে চেনা যায় এই মিথ্যা?

ডিপফেক যত উন্নত হচ্ছে, শনাক্ত করা তত কঠিন হচ্ছে—এ কথা সত্য। তবু কিছু লক্ষণ এখনো সতর্ক চোখে ধরা পড়ে। অনেক সময় মুখের নড়াচড়া ও কথার মিল ঠিক থাকে না, আলো-ছায়ার সামঞ্জস্যে গড়মিল দেখা যায়। চেহারা ও গলার রঙে অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে। কখনো চোখের পলক ফেলা বা অভিব্যক্তি অস্বাভাবিক মনে হয়। এগুলো নিছক কারিগরি ত্রুটি নয়, বরং কৃত্রিমতার ইঙ্গিত। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত প্রতিরোধও চলছে। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ডিপফেক শনাক্তে এআই-ভিত্তিক টুল তৈরি করছে, যেখানে মানুষের সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি, লিপ-সিংক ও ভিডিওর গঠন বিশ্লেষণ করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তির এই লড়াইয়ে একক কোনো সমাধান নেই।

সচেতনতাই সবচেয়ে কার্যকর

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জরুরি হলো জনসচেতনতা। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা প্রতিটি ভিডিও বা অডিও যাচাই না করে বিশ্বাস না করা, সন্দেহজনক কনটেন্ট শেয়ার না করা—এই অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে, যেন তারা প্রযুক্তির এই অনৈতিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকে এবং সমর্থকদেরও সংযত রাখে। ভবিষ্যতে ব্লকচেইনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন কনটেন্টের সত্যতা যাচাইয়ের পথ আরো সুগম হতে পারে—এমন ধারণাও দিচ্ছেন প্রযুক্তিবিদরা। তবে যত উন্নত প্রযুক্তিই আসুক, শেষ পর্যন্ত সত্যকে রক্ষা করার দায়িত্ব মানুষেরই।

বাংলাদেশে নির্বাচন গণতন্ত্রের উৎসব। সেই উৎসব যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি মিথ্যার কোলাহলে হারিয়ে না যায়—এ দায় শুধু রাষ্ট্র বা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের নয়, আমাদের সবার। সন্দেহ, যাচাই আর দায়িত্বশীল আচরণই পারে ডিপফেকের এই অদৃশ্য আক্রমণ থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন