ফিলিস্তিন সংকটে ইকবালের সমাধান প্রস্তাব

আবুল কাসেম আদিল
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৪: ৫৫

ফিলিস্তিন একটি ভূখণ্ডমাত্র নয়; এটি ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি ও মানবাধিকারের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভূমি বারবার পরাক্রমশালী শক্তির লোভের শিকার হয়েছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন ফিলিস্তিন ইহুদি বসতির নামে ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছিল এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাকে পড়ে স্বাধীনতা বিপন্ন হচ্ছিল, তখন আল্লামা ইকবাল তুলে ধরেছিলেন ফিলিস্তিনের কান্না ।

বিজ্ঞাপন

ইকবাল ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিন সফর করেন। তখন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল গঠিত হয়নি, তবে জোর চেষ্টা শুরু হয়েছিল। ইহুদিবাদীরা নিয়মিতই ফিলিস্তিনবাসীর ভূমি কেড়ে নিয়ে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করত।

ফিলিস্তিনে অবস্থানকালে তিনি বেশ কিছু কবিতা লেখেন। পরে যখন কবিতাগুলো বইয়ে সংকলিত হয়, ‘ফিলিস্তিনে লিখিত কবিতা’ বলে উল্লেখ করেন। সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি আল্লামা ইকবালের মুগ্ধতা প্রকাশিত হয়েছে কবিতায়—

হৃদয় ও চোখের জীবন মরুপ্রান্তরে প্রভাতের ছবি,

সূর্যের প্রস্রবণ থেকে বইছে আলোর নদী!

চিরন্তন সৌন্দর্য উদ্ভাসিত, বিদীর্ণ হলো ব্রহ্মাণ্ডের ঘোমটা,

হৃদয়ের হাজারো লাভ—এক নজরের ক্ষতিমাত্র!

(বালে জিবরীল)

ফিলিস্তিনের ক্রমবর্ধমান সংকট আল্লামা ইকবালকে বিচলিত করে। ফলে বক্তৃতা, বিবৃতি ও কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এর ন্যায়সংগত সুরাহার তাগিদ দেন। এসময় তিনি এক কবিতায় লেখেন—

ইকবালের সন্দেহ ইউরোপের সৌজন্য নিয়ে নয়।

সে প্রত্যেক নিপীড়িত জাতির ক্রেতা।

কিন্তু আমার হৃদয় জ্বলছে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের দুঃখে।

এই সমস্যার জট খুলবে না কূটনৈতিক নীতিতে।

তুর্কির নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়ে

বেচারা পড়েছে সভ্যতার ফাঁদে।

(যরবে কালীম)

ইন্তেকালের এক বছর আগে, ১৯৩৭ সালের ২৬ জুলাই, লাহোরে এক ভাষণে তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি আবেগ ও জবরদস্তিমূলক ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি সমাধান-প্রস্তাব পেশ করেন। মুসলমানদের জন্য ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবকে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

আল্লামা ইকবাল ফিলিস্তিনের সংকট একান্তই এখানকার অধিবাসীদের সংকট মনে করতেন না। একে তিনি সমগ্র আরবের, বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সংকট বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের উচ্চস্বরে ঘোষণা করা উচিত, ব্রিটিশ নেতারা ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে সংকটের সমাধান করবেন বলে ভেবেছেন, তা কেবল ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নয়; এই সংকট একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র ইসলামি বিশ্বকে প্রভাবিত করছে।’

মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর কাছে লিখিত এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘ফিলিস্তিন সমস্যা মুসলমানদের অস্থির করে তুলেছে। এশিয়ার দরজায় একটি পশ্চিমা সামরিক ছাউনি চাপিয়ে দেওয়া ইসলাম ও ভারতের জন্য বিপজ্জনক।’

ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে আরবদের জন্য লজ্জাজনক এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বুদ্ধিভ্রষ্ট প্রয়াস সাব্যস্ত করে ইকবাল বলেন, ‘উর্বর জমি ইহুদিদের দিয়ে আরবদের পাথুরে অনুর্বর জমির সঙ্গে কিছু নগদ অর্থ দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। এটি একটি নিম্নস্তরের ঘৃণ্য দর কষাকষি, যা মহান আরব জাতির জন্য যুগপৎ কলঙ্ক ও লজ্জার বিষয়।’

ফিলিস্তিনে যে সংকট ঘনীভূত হচ্ছিল, আল্লামা ইকবাল তা সমাধানকল্পে আরব ও তুর্কিদের সম্মিলিত প্রয়াস গ্রহণ করা অনিবার্য বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন, মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জীবন ও রাজনৈতিক স্বার্থ আরব ও তুর্কিদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে নিহিত। এজন্য তিনি এই দুই জাতিকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি উত্তরণের আহ্বান জানান।

আল্লামা ইকবাল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, ফিলিস্তিনের সংকট নিরসনে আরব রাষ্ট্রগুলোর শাসকদের যথেষ্ট ভূমিকা রাখার সাহস ও সুমতি হবে না। এজন্য তিনি আরব জনগণকে সমস্যা নিরসনে নিজেদের উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আরব জনগণের তাদের শাসকদের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া উচিত নয়। কেননা এসব রাজা-বাদশাদের বর্তমান অবস্থা এরূপ নয় যে, তারা নিজেদের বিবেক ও ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে ফিলিস্তিন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উপযোগী উপসংহারে পৌঁছাতে পারবেন।’

আল্লামা ইকবাল অন্তর্দৃষ্টিতে যা দেখতে পেয়েছিলেন, তা কালক্রমে বাস্তব সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আরব শাসকরা স্বজাতি—নৃতাত্ত্বিকভাবে আরব ও ধর্মীয়ভাবে মুসলিম—ফিলিস্তিনিদের পাশে সামরিকভাবে তো দাঁড়াতে পারেইনি, এমনকি আন্তর্জাতিক ফোরামে কণ্ঠগত ভূমিকা পালন করতেও সক্ষম নয়।

ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও ইহুদিদের সঙ্গে ফিলিস্তিনের সম্পর্ক উল্লেখ করতে গিয়ে ইকবাল বলেন, ‘ঐতিহাসিক ধারাক্রম অধ্যয়ন করলে স্পষ্ট হয়, ফিলিস্তিন একান্তভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের বিষয়। ইতিহাস সাক্ষী—উমর (রা.)-এর ফিলিস্তিনে আগমনের পরে আজ ১ হাজার ৩০০ বছর পর্যন্ত, এমনকি এর আগেও ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইহুদিদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ইহুদিদের ফিলিস্তিন থেকে জবরদস্তিমূলক বিতাড়িত করা হয়নি। তারা স্বেচ্ছায় বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ ফিলিস্তিনের বাইরেই রচিত হয়েছে।’

ফিলিস্তিন ইহুদিদের ভূমি, এই দাবির পক্ষে তাদের দলিল হলো, তারা এখানকার ভূমিপুত্র। ইকবাল তাদের এই ভ্রান্ত দাবি

প্রত্যাখ্যান করে বলেন—

ফিলিস্তিনের ভূমি ইহুদিদের—এ যদি সত্য হয়

স্পেনের ওপর অধিকার নেই কেন আরবদের?

(যরবে কালীম)

ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড কেড়ে নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে ইকবাল দেখেছেন ব্রিটিশ রাজের ষড়যন্ত্র হিসেবে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য শুধু এই নয় যে, এখানে তারা বসবাস করে শুধু এই ভূখণ্ডটির ফল, ফসল ও আলো-বাতাস উপভোগ করবে। বরং তাদের উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের একটি আঞ্চলিক ঘাঁটি তৈরি করে আরবদের মধ্যে পারস্পরিক অনৈক্য সৃষ্টি করা, আরবদের তটস্থ রাখা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। ইকবাল বলেন—

ইংরেজ শাসকদের অভিপ্রায় ভিন্ন;

কমলা, মধু আর খেজুর নয়।

(শাম ও ফিলিস্তিন, যরবে কালীম)

আল্লামা ইকবালের মৃত্যুর ১০ বছর পর ইসরায়েলের জন্ম। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অতিক্রান্ত হয়েছে ৭৫ বছর। এত বছরের কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত, আল্লামা ইকবাল প্রতিষ্ঠার আগেই এই ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির উদ্দেশ্য যথার্থ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন—ইসরায়েল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের ‘জমিদারি’র আঞ্চলিক প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করবে।

ঐতিহাসিকভাবেই আরবরা স্বাধীনচেতা। তাদের শৌর্য-বীর্য প্রবাদতুল্য। ইকবাল আশাবাদী ছিলেন, পূর্বপুরুষদের রক্তের উত্তাপ উত্তরপুরুষদের ধমনিতেও প্রবাহিত। সময়মতো রক্ত কথা বলবেই। প্রয়োজনমতো ঝলসে উঠে তারা ঠিকই পরাধীনতার জিঞ্জির ছিন্ন করবে—

যাদের উত্তাপ থেকে সময় এখনো মুক্ত নয়,

আমি জানি, সেই আগুন তোমাদের মধ্যে সুপ্ত আছে।

তোমার রোগের চিকিৎসা জেনেভাতেও নেই, নেই লন্ডনেও;

ইংরেজদের প্রাণশক্তি ইহুদিদের করতলে।

শুনেছি, পরাধীনতা থেকে মুক্তি—

আত্মমর্যাদাবোধ লালন করা ও তা কার্যকর করার মধ্যে।

(যরবে কালীম)

ইকবাল ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি সমস্যার গোড়ায় হাত দিয়েছেন। যারা সমস্যা তৈরি করে, তারা এর সমাধান করতে পারে না। ফিলিস্তিনে ইহুদি-সংকট তৈরি করেছে পশ্চিমারা। তারা এর সমাধান করতে পারবে না। এর সমাধান আরবদেরই করতে হবে। এটাই ইকবালের মতে ইসরায়েল-সংকটের একমাত্র সমাধান।

ফিলিস্তিনিরা তাদের পিতৃভূমি পুনরুদ্ধার, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছেন সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে। চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পিতৃভূমি পুনরুদ্ধারের লড়াই থেকে তারা কখনো পিছপা হননি। যাদের কাছে জীবনের চেয়ে স্বাধীনতা মূল্যবান, তাদের পৃথিবীর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আজ হোক বা কাল তারা বিজয়ী হবেই, প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস আবার মুক্ত হবেই—এটাই আল্লামা ইকবালের বিশ্বাস—

ভোরের আলোয় আলোকিত হবে আকাশ,

ঘুচে যাবে রাতের আঁধার।

সূর্যের প্রভাবে রাত শেষ হবে,

এই বাগিচা তাওহিদের গানে মুখর হবে।

(বাঙ্গে দারা)

আল্লামা ইকবালের ফিলিস্তিন-চিন্তা কেবল একটি জাতির প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ নয়, এটি একটি চেতনার আহ্বান। এই চেতনা আত্মসম্মানবোধের, স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের, ইতিহাসের শিক্ষা থেকে ভবিষ্যতের পথ নির্মাণের। ইকবাল বুঝেছিলেন শুধু আন্তর্জাতিক সমর্থন নয়, আরবদের মধ্যে ঐক্য, ঈমান ও আত্মবিশ্বাসই হতে পারে ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের মূল চাবিকাঠি। তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—যারা পরাধীনতা মেনে নেয় না, যারা সংগ্রামের পথ থেকে পিছু হটে না, বিজয় একদিন তাদের কাছেই ধরা দেয়।

ইকবালের কবিতা কেবল অতীতের দলিল নয়, আজও প্রাসঙ্গিক। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি আজও দখলদারিত্বের নিপীড়নে জর্জর, কিন্তু ইকবালের ভাষায়—‘যাদের উত্তাপ থেকে সময় এখনো মুক্ত নয়’, তাদের সেই ঘুমন্ত আগুন জেগে উঠবে। আলোর সেই প্রভাত নিশ্চয় আসবে, ফিলিস্তিন আবার মুক্ত হবে— এটাই ইকবালের বিশ্বাস, এটাই তার কবিতার অঙ্গীকার।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত