চব্বিশের আবাবিল

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৫, ১২: ২৩

ভয় আর অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে মেহেদী। যদিও ওর সামনে বসে থাকা মানুষটার মুখের দিকে তাকালে ভয়ের চেয়ে সাহস বেশি পাওয়া যায়। কিছু মানুষের চেহারা এমন হয়। তাকিয়ে থাকলে চোখে আরাম লাগে। মেহেদী বসে আছে বড় হুজুরের সামনে। নাভি ছুঁই ছুঁই সাদা দাড়ি, ভরাট ফরসা মুখ, মাথায় গোল করে বাঁধা পাগড়ি, কপালে কালো দাগ, টাকনু ছুঁই ছুঁই ঢিলাঢালা জুব্বা, বিশালদেহী মানুষটাকে দেখলেই বোঝা যায় উনিই বড় হুজুর।

বিজ্ঞাপন

সালাম দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল মেহেদী। বড় হুজুর ভরাট গলায় বললেন, ‘আসো’। হাতের ইশারায় সামনে পেতে রাখা জায়নামাজ দেখিয়ে বললেন, ‘বসো’। বড় হুজুরের মুখোমুখি বসে আছে সে। হুজুর মনোযোগ দিয়ে ভারী বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছেন। হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজছেন। ধীরে ধীরে তার মুখটা শক্ত হচ্ছে, কপালে ভাঁজ পড়ছে। আজই হুজুরের সঙ্গে মেহেদীর প্রথম দেখা। তারপরও হুজুরকে চিন্তিত দেখতে ওর ভালো লাগছে না। বইটা হাতে নিয়ে হুজুর যা খুঁজছে তা বের করে দিতে ইচ্ছে করছে মেহেদীর।

উত্তর-দক্ষিণমুখী বেশ বড় আর অন্ধকার একটা ঘর। আম-কাঁঠালের বড় বড় পাতা সূর্যের আলো আসতে দেয় না। রডলাইটের অপর্যাপ্ত আলো আর আতরের ঘ্রাণ ঘরটাকে কেমন যেন স্যাঁতসেতে ও রহস্যময় করে তুলেছে। ঘরের দেয়ালে বিভিন্ন মাদরাসার ক্যালেন্ডার আর তাফসির মাহফিলের পোস্টার। বেশ বড় একটা র‌্যাক। র‌্যাক ভর্তি ইসলামি বই। দক্ষিণ পাশে ঘরের একমাত্র জানালা ঢাকা পড়েছে র‌্যাকের পেছনে। র‌্যাকের সামনে কাঠের বাক্স। বাক্সটাই টেবিল। বাক্সের ওপর বই রেখে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছেন বড় হুজুর। হুজুরের সামনে বসে আছে মেহেদী। ঘরের উত্তর পাশে দরজা। দরজার বাইরে শরীর রেখে মাঝে মাঝে মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছেন নাসিরুদ্দিন। মেহেদীর বাবা।

বইয়ে মুখ রেখেই হুজুর প্রশ্ন করলেন, ‘কী নাম?’ ঘরে টাঙানো তাফসির মাহফিলের পোস্টার পড়ছিল মেহেদী। হঠাৎ প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল। উত্তর দিল, ‘জি, আমার নাম মেহেদী হাসান।’ হুজুর বই বন্ধ করে পাশে রাখলেন। তার মুখ হাসি হাসি। চিন্তার ভাঁজ দূর হয়েছে দেখে মেহেদীর স্বস্তি লাগতে শুরু করল।

-এই মাদরাসায় ভর্তি হতে চাও?

-জি হুজুর।

-কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়ালেখা করেছো?

-এবার ক্লাস থ্রিতে উঠেছিলাম।

-নয়ের ঘরের নামতা পারো?

-জি হুজুর।

-বলো তো শুনি।

হুজুর খেয়াল করলেন বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে তার সামনে বসা ছোট্ট ছেলেটা। গায়ে কমদামি কাপড়ের নতুন জুব্বা, টুপি ও পায়জামা। ছোট গোলগাল মুখ। শ্যামলা গায়ে সরিষা তেল চিকচিক করছে। মাদরাসায় আসার সময় মা নিজ হাতে তেল মেখে দিয়েছে বোঝা যায়। এক নিঃশ্বাসে নয়ের ঘরের নামতা শেষ করল মেহেদী হাসান নামের ভর্তি হতে আসা ছাত্র। মেহেদীকে দেখে বোঝা যায় দরিদ্র কিন্তু আদরের ছেলেটাকেই মাদরাসায় ভর্তির জন্য আনা হয়েছে।

-কয়ের নামতা পর্যন্ত মুখস্থ?

-পনেরোর।

-পনেরোর?

-জি হুজুর।

-বিশ পর্যন্ত পড়োনি কেন?

-আব্বু যে স্যার রাখছিলেন ওই স্যারের ঢাকায় চাকরি হয়ে গেছে। পনেরোর নামতা শেখানোর পর আর পড়ান নাই।

-কী কী অঙ্ক পারো?

-হুজুর, যোগ-বিয়োগ আর গুণ।

-ভাগ পারো না?

-ভাগ শেখানোর আগেই স্যার ঢাকা চলে গেছেন।

-বাংলা কবিতা মুখস্থ আছে?

-জি হুজুর।

-একটা বলো তো।

আবার বুক ভরে দম নিল ভর্তি হতে আসা ছেলেটা। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন বড় হুজুর। মাথা নিচু করে আবৃত্তি শুরু করল।

-ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ

দুপুর বেলার অক্ত

বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?

বরকতেরই রক্ত।

হাজার যুগের সূর্যতাপে

জ্বলবে এমন লাল যে,

সেই লোহিতেই লাল হয়েছে

কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!

প্রভাতফেরির মিছিল যাবে

ছড়াও ফুলের বন্যা

বিষাদগীতি গাইছে পথে

তিতুমীরের কন্যা।

চিনতে না কি সোনার ছেলে

ক্ষুদিরামকে চিনতে?

রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিল যে

মুক্ত বাতাস কিনতে।

পাহাড়তলির মরণ চূড়ায়

ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,

ফেব্রুয়ারির শোকের বসন

পরল তারই ভগনি।

প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি

আমায় নেবে সঙ্গে,

বাংলা আমার বচন, আমি

জন্মেছি এই বঙ্গে।

কবিতা শেষ করে হুজুরের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নিল মেহেদী।

-মাশাআল্লাহ। এত বড় আর কঠিন কবিতা তুমি মুখস্থ করে নিয়েছো? তোমার ঢাকায় চলে যাওয়া স্যার পড়াইছে নাকি?

-না হুজুর। এই কবিতা আমাদের হাইস্কুলের স্পোর্টস ডেতে অনেকে আবৃত্তি করে। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে।

কিছু একটা ভাবলেন বড় হুজুর। জানতে চাইলেন মেহেদীর সঙ্গে কে এসেছে। কথা না বলে পেছন ফিরে তাকাল। মেহেদীর দৃষ্টি অনুসরণ করে বড় হুজুর দেখলেন, ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সি একটা চিন্তিত উৎসুক মুখ। চেহারায় কঠোর পরিশ্রমের ছাপ। শরীর দরজার আড়ালে রেখে উঁকি দিয়ে ছেলেকে দেখছে। হাতের ইশারায় ডাকলেন হুজুর। এসে বসল মেহেদীর পাশে।

-আপনার নাম?

-মোহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন।

-মেহেদী হাসান কী হয় আপনার?

-আমার ছেলে, হুজুর।

-আপনার ছেলে তো খুবই মেধাবী। এত মাদরাসা থাকতে এই মাদরাসায় আনলেন কেন?

-হুজুর, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি, এই মাদরাসার অনেক নাম-ডাক শুনে নিয়ে আসছি।

-আপনি কী করেন?

-যখন যে কাজ থাকে, সেই কাজ করি।

-কী ধরনের কাজ?

-কখনো ধান লাগাই, কখনো ধান কাটি, পাট নিড়াই, পাট কাটি, এসব কাজ না থাকলে ঘরের চালের কাজ করি, ইটভাটায়ও কাজ করি।

-দিনমজুর?

-জি হুজুর।

-এখানে তো অনেক খরচ। প্রতি মাসে বোর্ডিং খরচই আসে আড়াই হাজার টাকা। বই-খাতা-হাত খরচ, জামাকাপড় তো আছেই। এত খরচ পোষাতে পারবেন?

-হুজুর, ঘরে আমরা দুজন। মেহেদীর একটা ছোট বোন আছে। তার খরচপাতি নেই। আমি দিনরাত কাজ করব। মেহেদীর মায় বাড়িতে হাঁস-মুরগি-ছাগল পালে। পালানে সবজি চাষ করে। দুজন মিলে একটা ছেলের লেখাপড়ার খরচ টানতে পারব। দরকার হলে আমি দিনরাত পরিশ্রম করব হুজুর। তাও আমার ছেলেকে কোরআনের হাফেজ বানাতে চাই।

বড় হুজুর গভীর মনোযোগ দিয়ে নাসিরুদ্দিনের কথা শুনলেন। নাসিরুদ্দিনের কথায় ভণিতা নেই। চোখে আছে শুধু স্বপ্ন আর দৃঢ়তা। যতবার ছেলের কথা বলছে, ততবার চোখ চকচক করে উঠছে। হুজুর বললেন, ‘বোর্ডিংয়ে দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য ছাড়ের ব্যবস্থা আছে। আমি মাসিক এক হাজার টাকা ছাড় দেওয়ার জন্য আবেদন করে দেব। বছর শেষে রেজাল্ট ভালো করলে ফুল ফ্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করব। আল্লাহ আপনাদের মনের আশা পূরণ করবেন ইনশাহআল্লাহ।’ নাসিরুদ্দিনের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। চিন্তার রেশমাত্র নেই। ‘হুজুর, দোয়া করবেন, আল্লা যেন আমার ছেলেকে কবুল করেন। আমি যেন হাফেজ সন্তানের বাবা হতে পারি।’

মায়ের দেওয়া চিড়া, নারু আরো শুকনা খাবার মেহেদীকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন নাসিরুদ্দিন। বিদায়ের আগে পুরোনো উপদেশ আওড়ালেন আবার, ‘কারো সঙ্গে মারামারি করবে না। কেউ কিছু বললে উত্তর দেবে না। সোজা হুজুরকে জানাবে। মন দিয়ে পড়ালেখা করবে। কারো খাবার বা অন্য কিছুতে হাত দেবে না। যে ছেলেরা দুষ্টুমি করে ওদের সঙ্গে মিশবে না। আমার কথা না শুনলে কিন্তু তোমার মা কষ্ট পাবে।’

বাবার উপদেশ ছেলেরা কখনো মানতে পারে না। উপদেশে মূলত স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করতে বলা হয় বলেই তা মানা যায় না। কিন্তু মেহেদী কীভাবে যেন বাবার কথাগুলোকেই স্বভাবে পরিণত করে নেয়। সবার আগে ঘুম থেকে ওঠে। তাহাজ্জুদ পড়ে পড়তে বসে। সারা দিন রেহেলের পেছনে সাপের ফণার মতো দুলতে দুলতে একের পর এক আয়াত মুখস্থ করে। বারবার আঘাত করে শক্ত গাছে পেরেক পোঁতার মতো অপরিচিত ভাষা হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পড়তে হয়।

এশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরেছেন নাসিরুদ্দিন। খাবারের জন্য বারবার ডাকছে তার স্ত্রী। নাসিরুদ্দিনের খাবারে মন বসছে না। মসজিদ থেকে ফেরার পথে বাজারের চায়ের দোকানে খবর দেখেছেন। ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের বড় ধরনের গন্ডগোল লাগছে। সরকার নির্বিচারে ছাত্রদের গুলি করছে। ছাত্ররা কী সব অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছিল। মাদরাসার ছাত্ররাও নাকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলন করছে। যদিও মেহেদী ঝই-ঝামেলায় যায় না। তারপরও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। গ্যাঞ্জামের বিষয়টা স্ত্রীকে বলবেন কি না বুঝতে পারছেন না। ভাত বেড়ে ডাকছে স্ত্রী। মন খারাপ নিয়ে খেতে বসলেন। ভাত মাখিয়ে প্রথম লোকমা মুখে দেবেন। তখন হুইসেল বেজে উঠল। পুলিশের গাড়ি নাকি অ্যাম্বুলেন্স বুঝতে পারলেন না নাসিরুদ্দিন। মুখের সামনে থেকে ভাতের লোকমা নামিয়ে রাখলেন প্লেটে। কান খাড়া করে বসে রইলেন। চিন্তিত মুখে বসে রইলেন তার স্ত্রীও।

তার বাড়ির সামনে এসে হুইসেল থেমে গেল। তখন শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মানুষের হট্টগোল বাড়ছে। খাবার আর মুখে দেওয়া হলো না। হাত ধুয়ে বের হলেন নাসিরুদ্দিন। তাকে অনুসরণ করল স্ত্রী। উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে পা বাড়ালেন। রাস্তার পাশে থামানো অ্যাম্বুলেন্স। মানুষজন এসে ভিড় করেছে। ইঞ্জিন বন্ধ হলো। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে নামলেন বড় হুজুর। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল নাসিরুদ্দিনের। হাত-পা ভারী হয়ে গেছে। হাঁটতে পারলেন না। একটা গাছ ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন। বড় হুজুরের মাথা নিচু। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছেন নাসিরুদ্দিন। হুজুর এগিয়ে এসে নাসিরুদ্দিনের কাঁধে হাত রাখলেন। তখনো তার মাথা নিচু। গ্রামের মানুষজন এসে ঘিরে ধরেছেন তাদের। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। সবাই বড় হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশ সময় নিয়ে কথা বললেন বড় হুজুর।

-নাসিরুদ্দিন ভাই, আপনি একজন হাফেজের বাবা হতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ আপনাকে শহীদ হাফেজের বাবা হওয়ার মর্যাদা দিয়েছেন। আপনি বলেছিলেন, আল্লাহ যেন মেহেদী হাসানকে কবুল করেন। জালেমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা আপনার সন্তানকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত