কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাংলা সাহিত্যে তার অবস্থান মাইলফলক হয়েই থাকবে। তার কবিতা ও গান বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তবে পাশ্চাত্যে তাকে নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা তুলনামূলকভাবে কম। নতুনভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে। নজরুলের গ্রহণযোগ্যতা ও কদর পাশ্চাত্য, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে পড়বে, স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কারণ, শোষণ-বঞ্চনার অভিশাপ নজরুলের কবিতাবলি ও গানকে সবসময় প্রাসঙ্গিক রাখবে। এমনকি চলমান বিশ্বপরিস্থিতিতে নজরুল রচনাবলির নতুনতর তাৎপর্য ও ব্যাখ্যাও আবিষ্কৃত হতে থাকবে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘কাজী নজরুল ইসলাম: দ্য ভয়েস অব পোয়েট্রি অ্যান্ড দ্য স্ট্রাগল ফর হিউম্যান হোলনেস’ বইতে মার্কিন গবেষক উইনস্টোন ল্যাংলি নজরুল ইসলামের নবতর প্রাসঙ্গিকতা আবিষ্কার করেছেন। অন্য এক রচনায় ওলন্দাজ গবেষক পিটার কুস্টার নজরুল ইসলামকে নতুনভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। আমরা এই প্রবন্ধে বহির্বিশ্বের আলোচনা-পর্যালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করব।
১
বর্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদ বিশ্বায়নের নামে এক নতুন রূপ ধারণ করেছে। হান্টিংটনের দ্য ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেশন্স এক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক মসলা জোগান দিচ্ছে। উইনস্টোন ল্যাংলি নজরুল ইসলামের ব্যক্তি-উন্মেষ, চিন্তা, স্বাধীনতা ও সাম্যভাবনাকে হান্টিংটনের ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’র সঙ্গে তুল্যমূল্য করে দেখেছেন। তার এ প্রয়াস একদিকে যেমন তার পাণ্ডিত্য ও সৃজনশীলতার পরিচয় বহন করে, তেমনি নজরুল ইসলামকে বিবেচনা করার প্রচলতা ভেঙে নতুন বিশ্লেষণের দরজা উন্মুক্ত করে।
উইনস্টোন ল্যাংলি আমেরিকান বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ। তিনি আটলান্টিক ইউনিয়ন কলেজ থেকে জীববিজ্ঞানে ব্যাচেলর অব আর্টস, হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইউরোপিয়ান ডিপ্লোম্যাটিক হিস্টরি নিয়ে মাস্টার অব আর্টস, একই প্রতিষ্ঠান থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স বিষয়ে পিএইচডি এবং সুফক ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস বোস্টন-এর একাডেমিক অ্যাফেয়ার্স-এর ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। লাভ করেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। ‘কাজী নজরুল ইসলাম: দ্য ভয়েস অব পোয়েট্রি অ্যান্ড দ্য স্ট্রাগল ফর হিউম্যান হোলনেস’ তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এই গ্রন্থে দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন্স-এর মোকাবিলায় নজরুল কাব্যের দর্শন ও উদ্দীপনা কীভাবে গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে, তার নানামুখী তাৎপর্যও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গ্রন্থের ‘নজরুলস ভয়েস অব পোয়েট্রি অ্যান্ড দ্য ডিরেকশন্স অব সিভিলাইজেশন্স’ অংশের খানিকটা এখানে অনূদিত হলো:
‘কবিতার কেন্দ্রীয় ভাবনা সম্পর্কে ব্রিটিশ দার্শনিক মাইকেল ওয়েক্শটের বিবেচনার আলোকে আমি নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করতে চাই। তার দৃষ্টিতে (এর সঙ্গে নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ খাপ খায়), কবিতার স্বর আপন ব্যক্তিসত্তার অনন্যতাকে প্রকাশ করতে চায়, চায় অন্যকে প্রণোদিত করতে এবং অন্য ও একই রকমের ততোধিক জটিল প্রতিমূর্তি নির্মাণ করতে তার সঙ্গে সংযুক্ত হতে। ...সভ্যতার অভিমুখ সেই কারণে, নজরুলের দৃষ্টিতে, কথিত ‘সংঘর্ষের’ বিষয় নয়, বরং অনেক বেশি ঐক্যের ব্যাপার।’
‘কবিতার, নজরুলের দৃষ্টিতে, বহুবৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের উৎসাহ ছাড়াও অন্য আরো কিছু প্রবণতা রয়েছে। আরো যেসব প্রবণতাকে সে সংশ্লিষ্ট করতে চায়, তার মধ্যে রয়েছে: ব্যক্তি এবং সংঘের ক্ষমতায়ন; বৈচিত্র্যের সত্যিকার বিকাশ; এবং মানবজীবন ও সমাজসমূহে নৈতিকতার নিশ্চয়তা।... একজন মানবসত্তা ক্রমে ক্রমে তার নিজ ব্যক্তিসত্তার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে, সে বিশাল, জটিল এবং অসীম ক্ষমতাশালী পৃথিবী সম্পর্কে সচেতন হয়—সেটা সেই জগৎ, যার মধ্যে ব্যক্তি নিজেকে নিষ্ক্রিয় একটা বস্তু বলে মনে করে। এভাবে নিজেকে অনুভব করার মানে হলো কেবল, অথবা এমনকি প্রাথমিকভাবে, কোনো স্বাধীন ইচ্ছার অনুভব ছাড়া নিজের মুখোমুখি হওয়া, আত্মপরিচয়ের অনুভূতি ছাড়াও। অর্থাৎ নিজেকে পৌরুষহীন বলে অনুভব করা। মানবসত্তা, অবশ্য—এমনকি যখন সে হীন পৌরুষহীন অবস্থায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হয় টিকে থাকার জন্য, তখনো সেই অবস্থা কখনো মেনে নিতে পারে না; সেসব সময় সে পরিস্থিতির বিরুদ্ধাচরণ করার উপায় খুঁজতে থাকে মরিয়া হয়ে, কখনো কখনো জীবন বাজি রেখেও। নজরুল, তার কবিতায়, অনবরত মানুষের ক্ষমতায়নের উপায় খুঁজেছেন, তাদের সক্ষমতা দিতে চেয়েছেন, যেন তারা একটা আশ্রয় তৈরি করে নিতে পারে, যেন তারা স্বেচ্ছায় তাদের গন্তব্য পছন্দ করে নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেখি তিনি চেয়েছেন কৃষকরা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য শ্রোতা বা পাঠকের ভাষার পরিবর্তে তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করুক, তাহলে অভিজ্ঞতার বর্ণনার ওপর তাদের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ‘ধর্মীয় অভিজ্ঞতা’ও প্রায়ই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, যা ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন্স’-এর গ্রন্থকারের আতঙ্কের কারণ। ক্ষমতায়নকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এরকম রচনা সম্ভবত ‘বিদ্রোহী’ই। এটা সেই কবিতা যেখানে ব্যক্তি কখনো নিষ্ক্রিয় নয়, সে সময় তার স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার বহিঃপ্রকাশে তাবৎ বিশ্বকে আশ্রয় করে।’
‘বিদ্রোহী’তে একজন ক্ষমতাবান কর্মীকে পাওয়া যায়; কিন্তু নজরুল সবচেয়ে ব্যতিব্যস্ত যে বিষয় নিয়ে, সেটা হলো জাড্যতার বিরুদ্ধতা, জড়বস্তু হওয়ার বিরুদ্ধে অবিরাম বিদ্রোহ। এই লড়াই এবং বিক্ষোভ কেবল তখনই শেষ হবে ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।’ সে একজন স্বাধীনতা আনয়নকারীও বটে—যে সমাপ্তি আনে—রাত্রির সমাপ্তি। এই মুক্তি আনার জন্য নির্দয় ‘বিদ্রোহী’ পদদলিত করে ‘যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল’কে—সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এইসব ‘নিয়ম’ ও ‘শৃঙ্খলা’র কানুন তৈরি করেছে মানুষকে (ব্রিটিশরা যাদের বলে প্রজা) অন্তর্মুখী করে তোলার জন্য, যেন তাদের শাসন করা যায়। এইসব ‘নিয়ম-কানুন’, যা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকীর্ণতা, ‘বিদ্রোহী’ তার মহা রণহুঙ্কার দিয়ে বাংলা তথা সারা বিশ্ব থেকে সেসবের মূলোচ্ছেদ করতে চায়। কারো কারো কাছে তাকে কিছুটা অদ্ভুত, আপত্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু তাদের জানা উচিত যে, সে ‘অচেতন চিতে চেতন’।
...আজকাল, পাশ্চাত্যে, মানববৈচিত্র্যের বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। কোনো সত্তার জন্য এটাকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, সে সত্তা হোক পৌরসভা, শহর, জাতি, সংস্কৃতি, সভ্যতা বা অন্য কিছু। নজরুল মানববৈচিত্র্য নিয়ে উল্লসিত; তিনি সর্বত্র সেটা দেখতে পেয়েছেন, একজন ব্যক্তিসত্তা হিসেবে যা দেখেছেন তার নিরিখেও। বাস্তবিকই এটা বলা অতিশয়োক্তি হবে না যে, কোনো একক সত্তা যদি একই সঙ্গে বহুত্বের অংশীদার না হয় তাহলে তাকে তিনি কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ বিবেচনা করতেন। ‘বিদ্রোহী’তে, ব্যক্তিসত্তা আবশ্যিকভাবেই বহুজন...। এমনটা হতে পারে যে, কেউ ‘বিদ্রোহী’কে একজন আন্তঃগ্রহপরিভ্রমণকারী হিসেবে বিবেচনা করবেন, সে কখনো নর্তক, ধ্বংসকারী, কখনো ঋষি, যোগী, বেদুইন, কখনো সামরিক নেতা, উড়ন্ত পাখি, কখনো বিচারক, কখনোবা উন্মাদ, ঈশ্বরের ঈশ্বর, কখনো যুদ্ধপাগল, শান্তিদাতা, বন্যা, কখনো নিভৃতচারী, কখনো ‘বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস’, বিষপানকারী, বঞ্চিতের ব্যথা, গৃহহারার বেদনা, অবমানিতের মর্মবেদনা, দেবশিশু, চিরকিশোর ইত্যাদি। এ রকম বহুবৈচিত্র্য বিরল।...
নজরুলের কবিতাস্বরের অবদানের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন্স’ তত্ত্বের দ্বন্দ্বমূলক পরিচয়ের ধারণা এবং ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’র দাবিকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করা।’ তার কাব্যচর্চার যুগে ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন্স’ ধারণাটির উদ্ভব হয়নি। কিন্তু নজরুলের কাব্যচর্চা করলে দেখা যাবে হান্টিংটন মানবসভ্যতাকে যে ধ্বংসকর অভিমুখে তাড়িয়ে নিতে চেয়েছেন নজরুল তার মোকাবিলায় ইতিবাচক জীবনধারণার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন। সে কারণে নজরুল আজ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। সেসব কথাই উইনস্টোন ল্যাংলি বলতে চেয়েছেন তার বইয়ে নজরুলের কবিতাকে নানা দার্শনিক ও রাজনৈতিক ধারণার মাপকাঠিতে ফেলে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
২
পিটার কুস্টার্স নেদারল্যান্ড্স-এর লিডেন ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক আইনের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি (১৯৭০) অর্জন করেন। তারপর ওয়াশিংটনের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তিন বছরের পোস্টগ্র্যাজুয়েশন কোর্স করেছেন। পিএইচডি ডিগ্রি (১৯৯৫) নিয়েছেন সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে, নেদারল্যান্ডস্-এর নিজমেগান ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গত শতাব্দীর সত্তর দশকের প্রথমার্ধে তিনি সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে ছিলেন কিছুকাল। তারপর আশির দশকে পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী ডাচ পিস মুভমেন্টে যোগদান করেন। ২০০৭-০৮ সালে নেদারল্যান্ড্স-এর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ-এ ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করেন। এই গবেষণার একটি অংশ ‘কাজী নজরুল ইসলাম: বেঙ্গলস প্রোফেট অব টলারেন্স’। এই প্রবন্ধে কুস্টার্স নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানে, প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়, রাজনীতি ও জীবনযাপনে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান এবং মানববৈচিত্র্যের প্রবণতাগুলোকে সংক্ষিপ্তাকারে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তার সামান্য কিছু নমুনা এখানে অনূদিত হলো :
‘নজরুল ইসলামের কবিতা ও অন্যান্য লেখায় তার সময়ের মেজাজ ও উপনিবেশিত ভারতের জাতীয়তাবাদী জাগৃতির মানসচেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। সেটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের সময়। নজরুল ইসলাম তার লেখায় এই জাগরণের উদ্দীপনার প্রকাশ ঘটান, যা তাকে বাংলায় ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তার সম্মান এনে দেয়। ...নজরুল ইসলাম কেবল এই বাস্তবতার ব্যাপারেই সচেতন ছিলেন না যে, তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উঠে দাঁড়ানোর জন্য ভারতীয় নারী ও পুরুষদের প্রাণিত করার প্রয়োজন রয়েছে। তার মধ্যে এই দূরদর্শিতাও ছিল Ñএবং সেটা তাকে কৃতিত্ব এনে দেয়, বিশেষ করে বাঙালি সমাজেÑ যে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রণোদনা কেবল কিছু সুবিধাপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে যেন শেষ না হয়, বরং সেটা যেন একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।
...ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটিশ শাসকরা মুসলিম সম্প্রদায়কে অব্যাহতভাবে কলঙ্কিত করতে থাকে। ফলে মুসলিমদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, যেটা তাদের মধ্যকার অবনয়নবোধ ও হতাশাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। বাংলার সাহিত্যের মঞ্চে নজরুল ইসলামের অভ্যুদয়ের বেশ আগেই ‘মুসলিম জাগরণ’ আন্দোলন শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশিত ভারতের সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিম জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার জন্য। নজরুল এই মুসলিম ‘পুনর্জন্ম’ আন্দোলনের একজন আগ্রহী নায়ক হিসেবে অগ্রবর্তী হন। ...যে সময় পশ্চিমা মিডিয়া এবং জনমত নির্মাতাদের কেউ কেউ ইসলামকে জন্মগতভাবে অসহিষ্ণু ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করতে তৎপর, তখন নজরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন; বিষয়টি গুরুত্ববহ। ঔপনিবেশিক ভারতে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে নজরুল জোর দিয়ে বলতে লাগলেন, নবী মুহাম্মদ (সা.) সহিষ্ণুতার সুসংবাদদাতা। ...নজরুল ইসলাম ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিরুদ্ধে শক্ত নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করলেন। এই কবি-লেখক সাগ্রহ সমর্থন দিলেন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুবিচারের আদর্শের প্রতি। নজরুল সচেতনভাবেই তার ধর্মীয় সাম্যের প্রচারণাকে যুক্ত করলেন অর্থনৈতিক সাম্যের প্রচারণার সঙ্গে।
নজরুলের লেখায় যেমন বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সাম্যের অঙ্গীকার কার্যকরভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি প্রকাশ পেয়েছে বাংলার শ্রমজীবী জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য-সংগ্রামের প্রতি শক্তিশালী অঙ্গীকার।
... নজরুল ইসলামের দৃষ্টিভঙি, যা প্রতিফলিত হয়েছে তার সৃজনশীলতার সময়ে (১৯১৯-১৯৪২) সেটা ছিল সময়ের অগ্রবর্তী পদক্ষেপ। তার ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা-বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।’
নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানে একইসঙ্গে কাব্যগুণ ও সংগীতের সুরলহরির মূর্ছনা শোনা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গায়ক ও গিটারবাদক রিচার্ড বাক্চুস ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অনুবাদ পড়ে বলেছেন, ‘তার শব্দগুলো এমন ‘রক অ্যান্ড রোল’ যে, আমি তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারি না।’
এসব আলোচনা-পর্যালোচনা পাঠ করে এ কথা বলা যায়, বিশ্ববাজারে কবি নজরুল ইসলামের রচনাবলির কার্যকর উপস্থাপন কেবল তাকেই নয়, বাংলা সাহিত্যকেও নতুনতর মাত্রায় অভিষিক্ত করতে পারে।

