আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

মুকুল চৌধুরী: মহৎ কবির প্রতিচ্ছবি

সোলায়মান আহসান
মুকুল চৌধুরী: মহৎ কবির প্রতিচ্ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশকাল বিশ শতকের ঊষালগ্নেই। বিহারী লাল ও মধুসূদন বাদ দিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল থেকে মাপ দিলে আধুনিক কবিতার বিকাশ পরিমাপে যে সময় পাওয়া যাবে, তা ওই শতবর্ষের সীমায় বেঁধে ফেলা যায়। বাংলা ভাষা বিকাশের মূল্যায়নেও ওই এক শতাব্দীর পরিক্রমাকে বিশেষ মর্যাদা দিতে হবে। এ শতাব্দীতেই আমরা পেয়েছি রবীন্দ্র-নজরুল প্রতিভা। যেকোনো ভাষার জন্য একই সময় এমন দুজন বিরাট প্রতিভার আবির্ভাব বিরল ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

এর পরের অতিক্রমণও ছিল সমৃদ্ধ ও বিকশিত। অর্থাৎ ত্রিশের লেখক-কবিরা। এখানেও আমাদের ভাষা-সাহিত্য প্রয়োজনীয় বিকাশে সমৃদ্ধি পেয়েছে। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকেও আমাদের ভাষার বিকাশ গতিহীন হয়ে পড়েনি। উৎকর্ষ, উন্নয়ন, সৃজনশীলতা- সবকিছুতেই সংহত গতি ক্রিয়াশীল ছিল। কিন্তু ষাটে এসে যেন থমকে দাঁড়াল আমাদের ভাষা- কি কবিতায় কি গদ্যে। সত্তর ও ষাটের পেছন পেছন নীরব বিস্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যায়। শুরু হয় হতাশা আমাদের সাহিত্য নিয়ে, শিল্প নিয়ে। না, শিল্পের আর মাধ্যমগুলো গতিহীন ছিল না। কেউ কেউ বেশ এগিয়ে নিয়েছেন নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, সংগীত ইত্যাদিকে।

এভাবেই দশক গড়িয়ে গড়িয়ে কালের অতলে হারিয়ে গেছে। আশির দশকও। এ দশকে আমরা একদিকে পেয়েছি কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশ। ইলেকট্রনিক্সের ছড়াছড়ি। স্যাটেলাইট মিডিয়া ও তারকাযুদ্ধ প্রস্তুতির বিবাদ, সঙ্গে পারমাণবিক সমরাস্ত্রের বাকযুদ্ধ। সাহিত্যশিল্পের নানা শাখায় চলেছে বিকাশের তুমুল প্রতিযোগিতা। কিন্তু যতটা প্রতিযোগিতা চলেছে, বিকাশ ঘটেনি সে তুলনায়। তেমন চিহ্নিত করার মতো সৃষ্টিশীলতা নেই।

এ দশক একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, শিল্প মানেই শুধু শিল্পের জন্য নয়, মানুষের জন্য। এ সুস্পষ্টতা থেকেই আশির দশকে হাজির হয়েছে কেউ আল্লাহ-বিশ্বাসী আস্তিক দর্শক নিয়ে শিল্পসাহিত্য চর্চায়। আর কেউবা নিরীশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা, পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতা ভোগবাদী দর্শনের অনুবর্তী হয়ে। না কেবল এই দশকেই দুটি ধারার গতি চিহ্নিত হয়নি। এ গতি শতবর্ষেরই। তবে বিগত কয়েক দশকে এর সুস্পষ্টতা এক বিবদমান বিশ্ব উপহার দিয়েছে আমাদের।

১৯৭১ সাল অনেক কিছুর টার্নিং কাল। সাতচল্লিশে ভারত ভাগের মাধ্যমে দুই খণ্ডের পাকিস্তান ও বিশাল ভারত- দুটি দেশের জন্মের মাধ্যমে উপমহাদেশের অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তনের ভেতর বাংলাদেশ নামে নতুন মানচিত্রের অবস্থান বিশ্ব মানচিত্রে একটা নতুন ইতিহাসের পদচিহ্ন আঁকে। হারানোর বেদনা ভুলে এ মানচিত্রের সরল মানুষেরা নতুন সমাজ কাঠামো গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানে মানুষ দেখতে পায় আকাশে সূর্যের আলোর তাপ দিন দিন ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে। সবাই মেনে নিলেও কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের জাগ্রত একাংশ মেনে নেয়নি। তারা শানিত করে কলম। বহমান দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবনবিশ্বাস ও দেশপ্রেম হলো তাদের কলমের ভাষা। নষ্ট-পচা আমদানি করা সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল সারি সারি ধনুকবাজ। এঁরা আশির দশকের। এঁরা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী।

এতসব কথার মূল প্রতিপাদ্য একজন কবি- আশির দশকের অন্যতম কবি মুকুল চৌধুরী। তিনি হঠাৎ... হ্যাঁ, মৃত্যু হঠাৎ আসে কারো জীবনে, গত মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাতের মধ্যভাগে সিলেট শহরের এক হসপিটালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মুকুল চৌধুরী শুধু কবি ছিলেন না, মননশীল প্রবন্ধ, কিশোর রচনা ও সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রভূত অবদান রেখেছেন। তবে মুকুল চৌধুরীর প্রধান পরিচয় কবি। তিনি আটটি কাব্যগ্রন্থের পিতৃত্বে সমাসীন ছিলেন। অন্যান্য গ্রন্থের মিলিত সংখ্যা ২৬। কাব্যগ্রন্থগুলো—১. অস্পষ্ট বন্দর (১৯৯১) ২. ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল (১৯৯৪) ৩. চা বারান্দার মুখ (১৯৭৭) ৪. সোয়াশ’ কোটি কবর (২০০৩) ৫. অপার্থিব সফরনামা (২০১১) ৬. কবিতা সমগ্র (২০১৮) ৭. মাটির ঘটনা ও ৮. মৃত্যুর চিত্রকল্প (২০২৪)।

আশির দশকের অনেকটা নীরব ও আত্মমগ্ন এ কবি সম্পর্কে আলোকপাত করতেই যে বিষয় সবচাইতে প্রণিধানযোগ্য, তা হলো আমাদের সাহিত্যের গতি কোন দিকে তা অনুধাবন করা। সেই গতির সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েই মুকুলকে খুঁজে পেয়েছি এক সুস্পষ্ট ধারায়, যাকে বুঝতে পারলেই মুকুল চৌধুরীর কাব্যভাষা অনুধাবন সম্ভব। সর্বোপরি মুকুল চৌধুরী একজন আল্লাহবিশ্বাসী আস্তিক কবি। যদি কোরআনের ভাষায় কবিকুলকে দুভাগে বিভক্তির দিকে তাকাই, তবে মুকুল চৌধুরী সাচ্চা ঈমানদার। বিভ্রান্ত নন এবং সৎকর্ম সম্পাদনকারী কবিশ্রেণির একজন। তার কবিতার ভাব বিষয় ও জীবনের গতির সঙ্গে সমান্তরাল।

সাহিত্যের মহৎ গুণ হচ্ছে বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তার ওপর নাজিলকৃত ধর্মগ্রন্থের ওপর। বিশ্বসাহিত্য? সব বড় কবি-সাহিত্যিকের মাঝে এ গুণের সম্মিলন লক্ষ করা যায়। আমাদের আলোচ্য কবির মাঝে এ গুণের উপস্থিতি লক্ষণীয়।

‘প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে তাশাহুদ পাঠকালে যে আঙুল এক আল্লাহর সাক্ষ্য দিতে অজস্রবার নিজের অজান্তেই খাড়া হয়ে ওঠে, তার ডগায় এখনো লেগে আছে উপসাগরের সেই ফেনা।’ (নতুন মানচিত্র, গাংচিল এবং সমুদ্রের আর্তনাদ/ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল)।

‘যে দেশে আমার বাস খররৌদ্র শস্যে ভরা হেমন্তের মাঠে

সে দেশে আমার জন্ম কাদাপানি লেপটে থাকা বর্ষার গর্জনে

সে দেশের কৃষকের ঘরে ঘরে কীভাবে মিটল শেষে

দিগন্ত রেখার সাথে মিশে থাকা নবীজির স্বদেশপিপাসা।’

(ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল/প্রাগুক্ত)।

‘বন্দি জীবনে আমি পরিশ্রান্ত ভীষণ

স্নায়ু আতপ্ত অবসন্ন এ যে বাতিলের একক আয়োজন

জ্যোতির্ময় নূরের ছায়া কত দূরে?

অন্তহীন পাপের পদচিহ্ন ঘুমাবেন তিনি কবে?’

(কাব্যঘর/মৃত্যুর চিত্রকল্প)

মুকুল চৌধুরীর কবিতায় সবচাইতে লক্ষণীয় প্রবণতা ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতনতা। বিশেষ করে ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের টুকরো টুকরো ঘটনা তার কবিতায় ধরা দিয়েছে। যেমন—

একজন দাম্ভিক আবরাহা তার অহংকারের অলংকার

সুবিশাল হস্তিবাহিনীর আগমন সংবাদে একজন স্বপ্নাচ্ছন্ন আমেনা

যিনি উদরে পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ ধরে আছেন

ঘর থেকে বাইরে আসছেন - বাইরে থেকে ঘরে,

ফুঁসে উঠছে তার গায়ের পশম।

(মূর্খতার আইয়াম। ফে. আ. সু. রু.)

সবশেষে যে কথাটি মুকুল সম্পর্কে বলতে হয়, যেকোনো শিল্পের থাকে নিজস্ব শৈলী, কলাকৌশল ও প্রকাশভঙ্গির কারুকাজ। এসবের মাধ্যমে শিল্প মহিমান্বিত হয়, বিশিষ্ট হয় এবং স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী হয়। যেকোনো বড় শিল্পী এসব ব্যাপারে সচেতন থাকেন। বড় শিল্পীকে তাই চেনা যায়। এসব ব্যাপারে মুকুল চৌধুরী সচেতন ছিলেন।

(জন্ম : ২২ আগস্ট ১৯৫৮ – মৃত্যু : ২২ এপ্রিল ২০২৫)

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন