আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

ঈদে মিলাদুন্নবী

বাঙালির আপন পার্বণ

ড. আহমদ আনিসুর রহমান
বাঙালির আপন পার্বণ

বাংলাদেশ সরকারের ধর্মসচিব এ বছরও ১২ রবিউল আউয়াল ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদ্‌যাপনের ঘোষণা করেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ও সর্ববৃহৎ ধর্ম সংস্থা ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় ঈদে মিলাদুন্নবী সরকারিভাবেই পালিত হয় সরকারি ছুটির মাধ্যমে।

বিজ্ঞাপন

পার্বণ

পার্বণ’ শব্দটি এসেছে ‘পর্ব’ শব্দ থেকে। বর্ধনশীল বৃক্ষের কাণ্ডে এক গ্রন্থি থেকে আরেক গ্রন্থি পর্যন্ত অংশকে ‘পর্ব’ বলা হয়। এটি গাছের বেড়ে ওঠার একেকটি ধাপ বা পর্যায় নির্দেশ করে। তেমনি সমাজের অগ্রগতির ধারায় সময়ের বিশেষ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, দিন বা সময়কালকে ঘিরে যে উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠান গড়ে ওঠে, তাকেই ‘পার্বণ’ বলা হয়।

এসব ঘটনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও মূল্যবোধ পার্বণের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয় এবং সংশ্লিষ্ট সমাজের সম্মিলিত অবচেতনায় তুলনামূলকভাবে স্থায়ী রূপে গেঁথে থাকে। এভাবেই পার্বণ একেকটি সাংস্কৃতিক স্মারক হয়ে ওঠে, যা সমাজের ঐতিহ্য, চেতনাবোধ ও মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

এই ধারাবাহিক ও মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ-সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করেই সমাজের টিকে থাকা এবং অগ্রগতি সম্ভব হয়। সে কারণে পার্বণ কেবল উৎসব নয়, বরং সমাজজীবনের এক অপরিহার্য বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান।

বাঙালির পার্বণ মিলাদুন্নবী (সা.)

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় ঈদে মিলাদুন্নবী সরকারিভাবে পালিত হয়। এ উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়, যা তার গুরুত্ব প্রকাশ করে। এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দখলের আগের বাংলার অন্তর্ভুক্ত বিহার, উড়িষ্যা ও বৃহত্তর আসামের অংশ—যেমন মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডসহ আসামেও ঈদে মিলাদুন্নবীতে সরকারি ছুটি থাকে।

সামাজিকভাবে মুসলমানরা এ দিনটি অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করেন এবং কেবল মুসলমানরাই নন, একান্ত সাম্প্রদায়িক চেতনার বাইরে থাকা হিন্দু ও অন্য অমুসলিমরাও এতে অংশ নেন।

এমনকি, কিছু লেখায় তার (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের) সাম্প্রদায়িক মনোভাবের আভাস পাওয়া গেলেও মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে তিনি শুধু অংশগ্রহণই করেননি, সেখানে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এই ইহজগতে আগমনের সানন্দ তাৎপর্য বর্ণনা করে শ্রোতাদের তাঁর (সা.) আদর্শ অনুসরণের উপদেশও দেন।

১২০৩ সনে বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিম এলাকায়, সীমিত পর্যায়ে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক প্রথম স্বাধীন বাংলার সালতানাত প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই অন্তত ওই অঞ্চলে সরকারিভাবে পার্বণ হিসেবে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ পালিত হয়ে আসছে। তার কিছু পরেই ১৩০১ সালে হজরত শাহজালাল (রহ.) বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্ব অঞ্চলে, তথা আসামের পশ্চিমাংশে আরেক সালতানাত প্রতিষ্ঠা করলে, সেখানেও সরকারিভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের প্রচলন শুরু হয়।

আরও কিছুদিন পর ১৩৪২ সালে (বা তার আশেপাশে) সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ সমন্বিত করে প্রথম ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করলে তখন থেকেই সমগ্র বাংলাদেশে সরকারিভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপন শুরু হয়।

সহস্রাধিক বছরে বিবর্তিত হয়ে আজকের বাংলাদেশ ও তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিস্তৃত বাঙালি সমাজে প্রেম, ভালোবাসা ও ভক্তির সবচেয়ে বড় পার্বণ হয়ে উঠেছে ঈদে মিলাদুন্নবী, যা নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বজগৎ থেকে ইহজগতে আবির্ভাব এবং ইহজগৎ থেকে পরজগতে আবির্ভাবের তারিখ ১২ রবিউল আউয়ালের বার্ষিক প্রেমসিক্ত, ভক্তিসম্পৃক্ত, ভাবগম্ভীর অথচ আনন্দঘন উৎসব-উদ্‌যাপন রূপ ঈদে মিলাদুন্নবী। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, মিলাদুন্নবী সর্ববঙ্গেই উদ্‌যাপিত বাঙালির অতি আদরণীয় পার্বণ।

বাঙালির প্রিয় আরবি নবী (সা.)

বাঙালির এই অতিপ্রিয় পার্বণ ঈদে মিলাদুন্নবী বাংলাদেশে হাজার বছরেরও অধিককাল ধরে পালিত হয়ে আসছে। কোটি কোটি বাঙালি তা পালন করলেও এই পার্বণের উৎসপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও তাঁর ইহলোকে আগমন ও পরলোকে গমনের ঘটনাগুলো ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের বাইরে দূর আরবভূমিতে অবস্থিত।

পার্বণ মূলত ঐতিহ্য; আর ঐতিহ্য হলো সামাজিক ইতিহাসজাত, যা নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা ভূখণ্ডের সীমায় আবদ্ধ নয়, বরং সংশ্লিষ্ট সমাজের ইতিহাস থেকে উৎসারিত। কারণ সমাজ গড়ে ওঠে জাতিগোষ্ঠীর মাধ্যমে, আর অনেক জাতিই ঐতিহাসিকভাবে সাধারণত যাযাবর ছিল। যেমন আজকের মার্কিন জাতি ও সমাজ, যা ২০০ বছর আগে প্রধানত ছিল সাগরপাড়ের ইউরোপে। একই কথা প্রযোজ্য অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের জাতি ও সমাজের ক্ষেত্রেও।

এই জাতিগুলোর একটি ঐতিহ্য হলো, যিশুখ্রিষ্টের জন্মোৎসবে তাঁর প্রতি সানন্দ ভক্তি প্রকাশের রূপক প্রতীক ‘ক্রিস্টমাস ট্রি’। অথচ এই তিন জাতির বর্তমান আবাসভূমি থেকে যিশুর জন্মস্থান ও জীবনযাপনস্থল হাজার হাজার মাইল দূরের মধ্যপ্রাচ্যে। তিনি নিজে কখনো এসব দেশে যাননি। এমনকি ‘ক্রিস্টমাস ট্রি’ও ওই অঞ্চলে জন্মায় না, তা এসেছে সুদূর ইউরোপ থেকে।

হিন্দু-ভারতীয় বৈদিক ঐতিহ্যের প্রাচীনতম পাদপীঠ ছিল সিরিয়ায়, মধ্যযুগে যা ছিল মুসলিম আরব সভ্যতার কেন্দ্র। এই তথ্য সম্প্রতি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তেমনি ‘জেন বৌদ্ধ’ সাধনা আজ জাপানের ঐতিহ্যের অংশ হলেও এর উৎস ভারতেই।

একইভাবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যে সবচেয়ে প্রিয় পার্বণ ঈদে মিলাদুন্নবীসহ বহু কিছুর উৎস আরবভূমি। এই বাস্তবতারই প্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, যেখানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কুটির হতে দূর আরবের স্বপন দেখি...।’

এই স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গে নিজ বাড়ি বা কর্মস্থলে বসে, কিংবা বৃহত্তর বাংলার অংশ, আজকের বাংলাদেশের কুমিল্লায়, যা তৎকালীন বৃহত্তর ত্রিপুরার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথবা বাংলাদেশের অন্য কোথাও। যেখানেই হোক না কেন, বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় কবির এই স্বপ্ন বাঙালির বৃহত্তর সংস্কৃতিরই প্রকাশ।

আগেই আমরা দেখেছি, মিলাদুন্নবী সর্ববঙ্গে উদ্‌যাপিত বাঙালির এক অতি আদরণীয় পার্বণ।

বিশ্বজনীন পার্বণ

ভালোবাসা ও ভক্তিতে বাঙালির নিজস্ব সর্বোচ্চ পার্বণ হলেও ঈদে মিলাদুন্নবী শুধু বাংলাদেশ বা উপমহাদেশে পালিত কোনো নব-আবিষ্কার নয়। বিশ্বের প্রায় সব মুসলিমপ্রধান দেশেই এটি কেবল সামাজিকভাবেই নয়, সরকারিভাবেও কমবেশি পালিত হয়—কমপক্ষে সরকারি ছুটির মাধ্যমেই তা স্পষ্ট।

মিসর, তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, কুয়েত, মরক্কো, ইরাক, আলজেরিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, শাদ, আফগানিস্তান, ইরান, লিবিয়া, ব্রুনাইসহ বিশ্বের প্রায় সব মুসলিমপ্রধান দেশেই ঈদে মিলাদুন্নবী সরকারি ও সামাজিকভাবে পালিত হয়, ব্যাপক সামাজিক পরিসরে তো বটেই।

এই উৎসব প্রথমে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে পালন করা হলেও সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক আকারে উৎসবমুখর পরিবেশে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপনের সূচনা ঘটে বাংলাদেশের বাইরে মিসর ও ইরাকে।

পশ্চিম ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের সাম্প্রদায়িক, স্বৈরাচারী ও সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক দখল ও অত্যাচার থেকে জেরুসালেমসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলকে এবং চরমপন্থি ‘গুলু’ শিয়া মতাদর্শের সহায়তায় ক্রুসেডারদের দ্বারা আক্রান্ত মিসরকে মুক্ত করেন সুলতান সালাহুদ্দিন আইউবি (রহ.)। তার পক্ষের মুজাহিদ সেনাপতি ও ইরাকের ইরবিলের আমির মুজাফফর উদ্দীন (রহ.) রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম বড় পরিসরে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপন শুরু করেন।

এটি ছিল খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধের অংশ—নবীপ্রেমে (সা.) মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও চেতনায় জাগ্রত করার এক কৌশলগত প্রয়াস।

বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশ ও বাঙালিও তা নিজস্ব আপন সর্বোচ্চ আদরণীয় পার্বণ হিসেবে পালন করে আর বলে বাংলাদেশের জাতীয় কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে—

‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে

যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে ॥

কুল মাখলুকে আজি ধ্বনি ওঠে কে এলো ওই

কালমা শাহাদাতের বাণী ঠোঁটে কে এলো ওই

খোদার জ্যোতি পেশানিতে ফোটে কে এলো ওই

আকাশ গ্রহ তারা পড়ে লুটে কে এলো ওই

পড়ে দুরুদ ফেরেশতা বেহেশতের সব দুয়ার খোলে ॥

মানুষে মানুষে অধিকার দিল যে জন

এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই কহিল যে জন

মানুষের লাগি চির দীনহীন বেশ ধরিল যে জন

বাদশা ফকিরে এক শামিল করিল যে জন ॥

এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী

ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি

আজই মাতিল বিশ্ব নিখিল মুক্তি কলরোলে ॥’

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন