দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে যখন বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয়, তখন থেকেই বাংলায় মৌখিকভাবে সিরাত বা নবীজিবনী চর্চার শুরু। অবশ্য লিখিতভাবে খোদা, মহাম্মদ, টুপি, পেকাম্বর (পয়গম্বর), আদম্ফ (আদম), গাজী, কাজী, ফকির ও মলানা (মৌলানা/মাওলানা) শব্দগুলো ত্রয়োদশ শতাব্দীর কবি রামাই পণ্ডিত তার ‘শূন্যপুরাণ’ কাব্যের ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ কবিতায় প্রথম ব্যবহার।
চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যস্ত অন্তত ৫০টি সিরাত-বিষয়ক কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘রসুল বিজয়’ কাব্যের একটি বিশেষ ধারা পরিলক্ষিত হয়। যেমন রসুল বিজয় – জৈনুদ্দিন (জ. ১৩৭১ – মৃ. ১৪৮১ খ্রি.), রসুল বিজয় – সাবিরিদ খান (শাহ বিরিদ খাঁ, জ.১৫১৭ – মৃ. ১৫৮৫ খ্রি.), রসুল বিজয় – সৈয়দ সুলতান (জ. ১৫৫০ – মৃ. ১৬৪৮ খ্রি.), রসুল বিজয় – শেখ চাঁদ (জ. ১৫৬০-মৃ. ১৬১৫ খ্রি.), রসুল বিজয় – আবদুল হাকিম (জ. ১৬২০ – মৃ. ১৬৯০ খ্রি.), রসুল বিজয় ও ওফাতনামা – গোলাম রসুল (আঠার শতক), রসুল বিজয় – আকিল মোহাম্মদ, রসুল বিজয় – শেখ সোলায়মান ইত্যাদি।
কবি জৈনুদ্দিন বা জয়েন উদ্দিনের পিতা মৈনুদ্দিন বা মঈন উদ্দিন। তিনি প্রথম খলিফা হজরত আবুবকর (রা.)-এর বংশধর বলে জানা যায়। জৈনুদ্দিন ছিলেন সুফীবাদী কবি। তিনি ১৪৭২–১৪৭৪ সালে ‘রসুল বিজয়’ নামে একটি পূর্ণগ্রন্থ রচনা করেন। এ সম্বন্ধে আমরা ১৩২০ বঙ্গাব্দে প্রথম জ্ঞাত হই মরহুম আবদুল করীম সাহিত্যবিশারদের কল্যাণে। এটি ডান থেকে বামে তুলট কাগজে লেখা ছিল। পাণ্ডুলিপিটির ১-৮ এবং ৫৭-সংখ্যক পত্রটি পাওয়া যায়নি। এতে ১-৬৩ পত্র বিদ্যমান। পরবর্তী সময়ে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘সাহিত্য পত্রিকা’র ১৩৭০ বঙ্গাব্দের শীত সংখ্যায় ড. আহমদ শরীফের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। অবশ্য জুন ২০০৭-এ এসে তরুণ গবেষক-লেখক নিজাম সিদ্দিকীর সম্পাদনায় ‘দি স্টেপ পাবলিকেশন’ থেকে ‘জয়েন উদ্দীনের রসুল বিজয়’ শিরোনামে পৃথক গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
এই কাব্যের বিষয়বস্তু ইরাকরাজ জয়কুমের সঙ্গে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুদ্ধবিবরণ। প্রথম থেকে আট পত্র খণ্ডিত বলে কাব্যের নাম ইত্যাদি পরিষ্কার জানা যায় না। তবে ভণিতা দেখে কাব্যের নাম ‘রসুল বিজয়’ বলে অনুমিত হয়—
১. শ্রীযুত ইচুপ খান জ্ঞানে গুণবন্ত
রসুল বিজয় বাণী কৌতুক শুনন্ত
২. রসুল বিজয় বাণী অতি আনন্দিত শুনি
মনে প্রীতি বাসিল সভান
৩. রসুল বিজয় বাণী সুধারস ধার
শুনি গুণিগণ মন আনন্দ অপার।
পাণ্ডুলিপির শুরুতে আটটি পাতা না থাকায় শুরুটা কেমন ছিল তা অজ্ঞাত। তবে মনে হয় এতে রেওয়াজ মতো হামদ, নাত, পীর-প্রশস্তি, প্রতিপোষক-পরিচিতি ও কবির আত্মপরিচয়াদি ছিল। যতদূর জানা যায়, জয়কুম ঐতিহাসিক পুরুষ ছিলেন। তিনি আর্মেনিয়ার রাজা ছিলেন বলে ব্লু মহার্ড উল্লেখ করেছেন। অন্যমতে তিনি অনৈতিহাসিক চরিত্র। কারণ জয়কুম নামটি উপমহাদেশীয়, এমনকি রাজা শব্দটিও। তাছাড়া ঐতিহাসিক সূত্রে বর্ণিত আছে রাসুল (সা.) ২৭টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু জয়কুম রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন বলে কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে বলা যায়, কবি বর্ণিত কাহিনি কাল্পনিক।
তবে কবির কাছে রসুল (সা.) এবং তার সাহাবিরা সীমাহীন শ্রদ্ধার ও মর্যাদার পাত্র ছিলেন। ফলে কবি তাদের সর্বাবস্থায় সম্মান, মর্যাদা ও বিজয়ের আসনে দেখতে চেয়েছেন। জয়কুম রাজার কাসেদ যখন অশোভন কথা বললেন, তখন রাসুলের বিবরণ দিচ্ছেন এভাবে—
‘এই কথা শুনি নবী কহিতে লাগিলা।
অনল বরণ হই গর্জিয়া উঠিলা।।
অন্দরেতে যাই আলি জব করিব গরু।
সেই শের থোন দিমু তোমার রাজার জরু।।
কলিমা পড়াইমু সব ভজাইমু জিগির।
বলিহীন শাস্ত্র পূজা না রাখিমু ফিকির।।’
এহেন সংবাদ যখন কাসেদ রাজাকে জানাল তখন তিনি চিন্তিত হলেন। তবে আচমিরি নামক জনৈক বীর রাজাকে আশ্বাস দিল—‘মারিয়া ধাবাম গিয়া জথ মুসলমান।’
রাসুল (সা.)-এর সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা এভাবে বর্ণিত হয়েছে—
‘কেহ অশ্বে কেহ গজে কেহ দিব্য রথে
সুসজজ হইলা সব সংগ্রাম করিতে।
তার পাছে সুসজ্জ হইলা নবীবর
আকাশে উদিত যেন হইল শশধর।
ধবল অশ্বেতে নবী আরোহিলা যবে
আকাশের মেঘে ছায়া ধরিয়াছে তবে।’
যুদ্ধের দৃশ্য ‘রসুল বিজয়’ কাব্যে চিত্রিত করেছেন এভাবে—
পদাতিক পদধূলি ঢাকিল আকাশ
দিনে অন্ধকার, নাহি রবির প্রকাশ।
গজে গজে যুদ্ধ হৈল দন্ত পাশাপাশি
অশ্বে অশ্বে যুদ্ধ হৈল দুই মেশামেশি।
ধানুফি ধাযুকি যুদ্ধ অস্ত্র বরিষণ
বরিষার মেখে যেন বরিসে সঘন।
অস্ত্রজালে ভরি গেল গগন মণ্ডল
বীরের গর্জনে ভূমি করে টলমল।
গদা গদা ঘরিষণে উল্কা পড়ে খসি
দীপ্তিমান হই গেল অন্ধকার নিশি।
খড়্গ গড়্গ যুদ্ধ করে উঠে খর খরি
ভিনসূর্য হই যেন চমকে বিজুরি।
অন্যে অন্যে মল্ল করে হই জড়াজড়ি
বাজিল তুমুল যুদ্ধ ভূমিতলে গড়ি।’
কাব্যে কাহিনির অতিরঞ্জন থাকলেও সাহিত্য বিচারে তা অনবদ্য। ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন—‘এই রসুল বিজয় দিয়েই বাংলা ভাষায় চোখে দেখা রক্ত-মাংসের মানুষের জীবনকথা বা চরিতকথা লেখার শুরু।’ (আহমদ শরীফ সম্পাদিত জয়নুদ্দীন বিরচিত রসুল বিজয়, সাহিত্য পত্রিকা, শীত ১৩৭০, পৃ. ১২৬)
‘রসুল বিজয় কাব্য রচনায় জৈনুদ্দিন কোনো ফারসি কাব্যকে অনুসরণ করলেও কবির স্বাধীন শিল্পকৌশল তাতে ব্যাহত হয়নি। কাব্য রচনায় কবিরাজ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন, সেই সূত্রে কাহিনিতে যে কাব্যরস পরিবেশন করেছেন, তাতে এই বীরত্বব্যঞ্জক উপকথা যুগ যুগ ধরে সাধারণ বাঙালি মুসলমানের মনে জাগিয়ে রেখেছে ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির রূপ ও রীতি, ধারা ও ধারণা।’ (আজহার ইসলাম-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি, পৃ. ২৭)।
যতদূর জানা যায়, কবি জয়নুদ্দীন গৌড়ের সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রি.) সভাকবি ছিলেন। এমনও ধারণা করা হয় যে, তিনি পদ্মাতীরবাসী ছিলেন।

