সোনারগাঁ লোকজ উৎসব পানামনগর…

মোহনা জাহ্নবী
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ৪৫
আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩: ৩৪

রাজধানীর নিকটবর্তী একটি জেলা নারায়ণগঞ্জ। এর একটি উপজেলা সোনারগাঁ। দূরত্ব কম থাকার দরুন এবং দেখার মতো অনেক কিছু আছে বলে পর্যটন সমৃদ্ধ এই নগরীতে যাওয়া হয়েছে একাধিকবার। নারায়ণগঞ্জে কী কী দেখেছি, সেসব গল্প নিয়ে আজকের লেখা

বিজ্ঞাপন

লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর

সোনারগাঁয়ের একটি আকর্ষণীয় জায়গা হচ্ছে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। এ জাদুঘরে কয়েকবারই যাওয়া হয়েছে আমার। পানাম নগরের সঙ্গে জাদুঘরের দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। তাই সোনারগাঁ ঘুরতে গেলে সহজেই এ দুটি জায়গা ঘুরে দেখা যায়।

লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, আবহমান গ্রাম বাংলার লোক সাংস্কৃতিক ধারাকে বিকশিত করার উদ্যোগে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরীর একটি পুরোনো বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। পরে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ১৫০ বিঘা আয়তনের কমপ্লেক্সে খোলা আকাশের নিচে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশে গ্রামীণ রূপকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের পরিচয় তুলে ধরতে শিল্পী জয়নুল আবেদিন এই জাদুঘর উন্মুক্ত পরিবেশে গড়ে তোলার প্রয়াস নেন এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্সটি প্রায় ১০০ বছর পুরোনো সর্দার বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। এই জাদুঘরে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। প্রবেশ করার পর চোখে পড়বে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি ভাস্কর্য, ঈশা খাঁর ভবন, গরুর গাড়ির ভাস্কর্য ইত্যাদি। জাদুঘরের ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নৌকার ক্ষুদ্র সংস্করণ, কাঠের দরজা, মূল্যবান জিনিস রাখার কাঠের বাক্স, নকশিকাঁথা, নকশিকাঁথায় বাংলাদেশের মানচিত্র, কাঠের পালঙ্ক এবং আরো অনেক নিদর্শন।

প্রাকৃতিক পরিবেশবেষ্টিত জাদুঘরটি অন্য আট-দশটি জাদুঘরের মতো নয়, এ জাদুঘরের আবেদন অন্যরকম। জাদুঘরের ভেতরে শান্ত জলাধারও আছে। আছে কেনাকাটার জন্য কিছু স্থায়ী দোকানপাট। সব মিলিয়ে বারবার ঘুরতে যাওয়ার ও বাঙালি সংস্কৃতিকে কাছ থেকে দেখার মতো অনিন্দ্য সুন্দর একটি জাদুঘর এটি। জাদুঘরের প্রবেশমূল্য ৫০ টাকা। জাদুঘরের ভেতরে ঈশা খাঁর বাড়ি বা বড় সর্দার বাড়ি দেখতে চাইলে, সেক্ষেত্রে প্রবেশমূল্য মোট ১৫০ টাকা।

কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

সোনারগাঁয়ে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে প্রতি বছর কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব হয়। এ মেলাটি বেশ জনপ্রিয়। প্রতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত মাসব্যপী হয় এই মেলা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি এবং হস্তশিল্প, কারুশিল্প প্রদর্শনী ও বিক্রির মাধ্যমে জনসাধারণের মনে এসব সংরক্ষণের প্রতি আরো সচেতনতা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা এই মেলার লক্ষ্য।

মেলার খবর জেনেই গুলিস্তান থেকে রওনা দিলাম সোনারগাঁয়ের উদ্দেশে। গিয়ে দেখি অনেকটা জায়গাজুড়ে মেলা বসেছে। ঘুরে দেখলাম পুরো মেলা প্রাঙ্গণ। বাহারি পণ্যের সমাহার দেখে মন উৎফুল্ল হয়ে গেল। কী নেই সেখানে? মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিস, হাতে বোনা পোশাক, গহনা, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, শীতলপাটি, নকশিপাখা, লক্ষীসরা থেকে শুরু করে সব আছে। শুধু তাই নয়, অনেক খাবারের দোকানও দেখতে পেলাম। ছোটবেলায় মেলায় ঘুরতে গেলে যেসব খাবার চোখে পড়ত, তেমন অনেক খাবারের আয়োজন দেখলাম। এমনকি শিশুদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাইডও রয়েছে। মেলা থেকে পছন্দসই কিছু জিনিস কিনে নিলাম। দামও একদম হাতের নাগালে। এটি এমন একটি প্রাণের মেলা, যেখানে বারবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করবে।

পানাম নগর

নারায়ণগঞ্জের একটি ঐতিহ্যবাহী পুরোনো নগর হচ্ছে পানাম নগর। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক পর্যটক ছুটে আসেন এই পানাম নগর দেখতে। আমি নিজেও গিয়েছি কয়েকবার। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরোনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বার ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, প্রাচীন সোনারগাঁয়ে বড় নগর, খাস নগর এবং পানাম নগর নামে তিনটি শহর ছিল। তার মধ্যে পানাম নগর ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল এই নগরের বিস্তৃতি। বাংলার প্রথম রাজধানী কিন্তু ছিল এই সোনারগাঁয়েই; যা ১৫ শতকে ঈশা খাঁ স্থাপন করেছিলেন। মূলত পানাম ছিল বাংলার সে সময়ের ধনী ব্যবসায়ীদের বাসস্থান। সেসব ব্যবসায়ীর ব্যবসা ছিল ঢাকা-কলকাতাজুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই নগর। সুলতানি আমল থেকে এখানে বিকশিত ছিল বাংলার সংস্কৃতি; যা আজও বহমান।

পানামে এখন যে বাড়িগুলো টিকে আছে, তার স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হতে হয়। অনুমান করা যায়, তখনকার সময়ে নগরটি সত্যিই ভীষণ সমৃদ্ধ এবং সাজানো গোছানো ছিল। পথের দুপাশের সারি সারি বাড়ি পরিকল্পিত একটি নগরের চিত্রই তুলে ধরে। সেখানে কিছু পুকুরও আছে। একসময় সেসব শান বাঁধানো পুকুরঘাটেও জৌলুস ছিল। এখন সবই ভগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। তবু তা দেখেও মন জুড়িয়ে যায়। পানাম নগরের প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা।

সাবদি বন্দর

নারায়ণগঞ্জের সাবদি গ্রাম দুটি কারণে বেশি পরিচিত। প্রথমত, সাবদি বন্দর। দ্বিতীয়ত, ফুল চাষের জন্য। শীত মৌসুমে সেখানে অনেক সরিষার চাষ হয়। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারির দিকে টগর, কাঠমালতি, গাঁদা, ডালিয়া, জিপসি এমন অনেক ফুলে ছেয়ে থাকে পুরো সাবদি গ্রাম। আমরা অবশ্য ফুলের মৌসুমে যাইনি। তবে আমাদের ভ্রমণও খুব উপভোগ্য ছিল। যুক্তরাজ্য থেকে এক বন্ধু এসেছিল বাংলাদেশে বেড়াতে। তার বাংলাদেশে কাটানো দিনগুলো কীভাবে রঙিন করে তোলা যায়, সেই চেষ্টা ছিল সব সময়। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি এবং শেষমেশ তার বিদায় অনুষ্ঠান পর্ব আয়োজন করেছিলাম সাবদি বন্দরে। বাস থেকে চাষাড়া নেমে নৌকায় নদী পার হয়ে রিকশাযোগে পৌঁছেছিলাম বন্দরটিতে। একটা নৌকা ভাড়া করেছিলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা। নদীপথে কিছুটা ভ্রমণের পর নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে আমরা ভাসতে থাকলাম আর সবাই গান, কবিতা, স্মৃতিকথা, উপহার দিয়ে একে একে তাকে বিদায় জানাচ্ছিলাম। বলা বাহুল্য, জীবনে এমন সুন্দর সন্ধ্যা খুব কমই আসে।

সাবদির অন্যতম একটি জনপ্রিয় খাবার বৌয়া ভাত (খুদের ভাত) ও ভর্তা। প্রতি শুক্রবার সকালে সাবদি বাজারে পাওয়া যায় এই খাবারটি। তাই সেখানে যদি শুক্রবারে যাওয়া হয়, তাহলে এ খাবারটা মিস করা ঠিক হবে না। আর জায়গাটি একটু ভেতরে হওয়ায় আমার মনে হয়, ঘুরতে গেলে নিরাপত্তার জন্য সন্ধ্যার আগেই সেই স্থান ত্যাগ করা উচিত।

কীভাবে যাবেন

সোনারগাঁ যেতে ঢাকার গুলিস্তান থেকে দোয়েল, স্বদেশ কিংবা বোরাক বাসে চড়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে। ভাড়া ৬৫ টাকা। সেখান থেকে অটো বা রিকশায় যেতে হবে জাদুঘর অথবা পানাম নগরে। ভাড়া জনপ্রতি ২০-৩০ টাকা। যেতে পথে প্রথমে পড়বে জাদুঘর। প্রতি বুধ ও বৃহস্পতিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে। আর নারায়ণগঞ্জ যেতে গুলিস্তান থেকে বিআরটিসি বাসে চড়তে পারবেন। ভাড়া নেবে ৪৫ টাকা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত