লন্ডনের গ্রিনিচ মান মন্দির সময়ের কেন্দ্র

ফখরুল আলম
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১১: ৫৭

লন্ডনের গ্রিনিচ মান মন্দির পৃথিবীর একটি ঐতিহাসিক স্থান, যেখান থেকে সময় নির্ধারণ করা হয় পুরো বিশ্বের। গ্রিনিচ মান মন্দির এবং গ্রিনিচ মান সময়—দুটি শব্দ ছোট-বড় সবার কাছেই খুব পরিচিত। ছোটবেলা আমরা ভূগোল বইতে অনেক পড়েছি, তবে অনেকেরই হয়তো মনে নেই, যে কারণে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেকের মতো আমারও জানার প্রবল ইচ্ছা ছিল। তবে এই শব্দ দুটির আসল অর্থ এবং এর ইতিহাস খুব কম মানুষেই জানেন। প্রায় সময়ই লক্ষ করেছি, অনেক চাকরির ক্ষেত্রে সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা কিংবা বিসিএস পরীক্ষায়ও গ্রিনিচ মান সময় নিয়ে অনেক প্রশ্ন আসে। আমিও জীবনের কোনো একসময় চাকরির ভাইভা বোর্ডে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লন্ডনে আসার পরপরই গ্রিনিচ মান মন্দির ঘুরে দেখি।

বিজ্ঞাপন

গ্রিনিচ মান মন্দির এবং গ্রিনিচ মান সময় শব্দগুলো সবই এলোমেলো। তাই বুঝিয়ে বললে যা হবে—গ্রিনিচ মান সময় হচ্ছে আন্তর্জাতিক সময় নির্ধারণের মানদণ্ড। অন্যদিকে, মান মন্দিরের অর্থ পর্যবেক্ষণাগার। ফলে অনেকেই প্রাথমিকভাবে মান মন্দির বলতে কোনো মন্দির ভাবলেও এটি মূলত ইংল্যান্ডের গ্রিনিচে অবস্থিত ব্রিটিশ রয়েল পর্যবেক্ষণাগারকে নির্দেশ করে থাকে।

ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের পশ্চিমে টেমস নদীর উত্তরে গ্রিনিচ পার্কের পাহাড়ি চূড়ার ওপর অবস্থিত গ্রিনিচ মান মন্দির। যেখানে পৃথিবী হয়েছে দ্বিখণ্ডিত। ১৬৭৫ সালে ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস গ্রিনিচকে ইংল্যান্ডের প্রথম মান মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ব্রিটেনের এই মান মন্দিরটিকে পৃথিবীর মূল মধ্যরেখা হিসেবে ধরা হয়। গ্রিনিচের প্লাসেন্টিয়া প্রাসাদটি পৃথিবীর একদম মূল মধ্যরেখায় অবস্থিত। এ কারণে গ্রিনিচের সময়ের ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর সব দেশের সময় নির্ণয় করা হয়। যে কারণে এটিকে ইংরেজিতে বলা হয় গ্রিনিচ মিন টাইম বা জিএমটি।

বিশ্ব পর্যটকরা গ্রিনিচ মান মন্দিরটিকে (রয়েল অবজারভেটরি) দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে লন্ডন ভ্রমণ করেন। এটি মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক বিবেচনায় একটি আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধতা লাভ করছে। দিন দিন এই স্থানটি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একটি অনন্য দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রতিদিন সেখানে হাজার হাজার পর্যটকের পদচারণে মুখরিত থাকে।

Greenwich-Mann-Temple-2

এই সেই শূন্য ডিগ্রি দ্রাঘিমা রেখা, যে রেখার মাধ্যমে পৃথিবীকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। এ কথায় ঐতিহাসিক এই স্থান থেকেই বিশ্বজুড়ে সময়ের মান ছড়াচ্ছে। এই শূন্য ডিগ্রি দ্রাঘিমা রেখার পূর্বদিকে গেলে প্লাস(+) আর পশ্চিম দিকে গেলে মাইনাস(-) হয়। সেই সঙ্গে দ্বিখণ্ডিত পৃথিবীর সব দেশের সময় নির্ধারিত হয়। গ্রিনিচের সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের পার্থক্য +৬। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সময় থেকে ছয় ঘণ্টা বেশি। গ্রিনিচ মান মন্দিরের ভেতরে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি ঘড়ি, যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গ্রিনিচ মান মন্দির (রয়েল অবজারভেটরি)। আর যার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় আন্তর্জাতিক সময়।

লন্ডনের ঐতিহাসিক গ্রিনিচ পার্ক, যেখান থেকে ইংল্যান্ডের অদ্বিতীয় ঐতিহ্যবাহী টেমস নদী অবলোকন করা যায়। যে টেমস নদী হাজার বছর ধরে আনন্দ আর বিনোদনের সুযোগ করে দিয়েছে ইংল্যান্ডবাসীকে। টেমস নদীর বৈচিত্র্যপূর্ণ আনন্দের সাথি হতে পারবেন আপনিও। পাশেই টেমস নদীর তলদেশ দিয়ে রহস্যময় সুড়ঙ্গ দেখতে পারেন। যার রহস্য অনেকেরই অজানা। মূলত গ্রিনিচ একটি শহর, যে শহর থেকে পৃথিবীর সময় হিসাব করা হয়। গ্রিনিচ টাউনের কিছু দর্শনীয় স্থান খুবই মনোরম। এছাড়া শহরজুড়ে রয়েছে নানা স্থাপত্যশিল্প, যা যেকোনো দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করবে।

গ্রিনিচ মান মন্দিরে প্রবেশ করার আগেই নজরে পড়বে শতবছরের পুরোনো বিশাল একটি জাহাজ। যার নাম ‘কার্টিসার্ক’। এই জাহাজটির বয়স প্রায় ১৫০। ব্রিটিশ বণিকরা এই জাহাজ নিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০ দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। যার মধ্যে ব্রিটিশশাসিত ভারতসহ অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এই বাণিজ্যিক জাহাজটি ভিন্ন ভিন্ন দেশ ঘুরেফিরে আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিলেতের আমাদের পূর্বসূরির অনেকেই জলের ওপর ভর করে এই জাহাজের মাধ্যমে বিলেত আসা গল্প জুড়ে আছে। জাহাজটি বর্তমানে একটি মিউজিয়াম। টিকিট কেটে এই মিউজিয়ামটি পরিদর্শন করা যায়।

প্রাইম মেরিটিয়ান, জাতীয় ম্যারিটাইম জাদুঘরসহ বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে গ্রিনিচ মান মন্দিরের (রয়েল অবজারভেটরি) পাশে। এসব জাদুঘরে হাজার বছরের অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালে রানি এলিজাবেদ দ্বিতীয়ের রাজত্বের ২৫তম বর্ষপূর্তিতে তিনি গ্রিনিচে একটি জাহাজে আয়োজিত নাট্যাভিনয় প্রদর্শনে উপস্থিত ছিলেন। তার ইতিহাসসহ সংরক্ষিত রয়েছে রাজ পরিবারের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার মুহূর্তগুলো। পাশেই রয়েছে গ্রিনিচ হাসপাতাল, বিখ্যাত গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রিনিচ থিয়েটারসহ বিখ্যাত স্থাপনা, মূর্তি, চিত্রকর্ম এবং অনেক ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। যা যুগ যুগ ধরে বিশ্ব পর্যটকদের আকর্ষণ করছে।

Greenwich-Mann-Temple-3

আন্ডারগ্রাউন্ডের মাধ্যমে লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী স্টেশন ক্যানারি ওয়ার্ফ থেকে ডিএলআর, যা চালক ছাড়া ট্রেনের মাধ্যমে এরোস্টোন স্টেশন থেকে হেঁটে চলে যাওয়া যায়। আশা করি, আপনিও আপনার প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন স্বপ্নের দেশ—ইংল্যান্ডের লন্ডনের ঐতিহাসিক স্থান গ্রিনিচ মান মন্দির।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত