দেখে এলাম চীন

খায়রুল আলম বেলাল
প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২: ১২

পৃথিবীতে আমার বেশ ক’টি দেশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এবার সুযোগ এলো চীন দেখার, তাই আর হাতছাড়া করলাম না। একটি ট্রাভেল এজেন্টের মারফত আমিও চল্লিশ জনের দলের সঙ্গে এই আট দিনের প্যাকেজ ট্যুরে স্ত্রীসহ শামিল হয়ে গেলাম।

বিজ্ঞাপন

আমরা প্রথমেই ঢাকা থেকে সরাসরি ফ্লাইটে বেইজিং যাই। সেখানে তিন দিন অবস্থানের পর বুলেট ট্রেনে আমরা সাংহাই চলে যাই। সেখানে তিন দিন অবস্থানের পর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে গোয়াংজুতে গিয়ে দুই রাত কাটিয়ে তৃতীয় দিন সরাসরি ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে আসি।

মাত্র আট-নয় দিনে একটি দেশের বলতে গেলে ভালমতো কিছুই দেখা সম্ভব নয়, আর বিশেষ করে দেশটি যদি হয় চীন! তবে আমাদের ট্যুর অপারেটর এই ক’দিনে যতটা সম্ভব সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানই আমাদের দেখানোর চেষ্টা করেছেন।

China-2

আনন্দের বিষয় হচ্ছে, ট্যুর অপারেটর রাশেদ (ATMC Holidays) স্বয়ং এই ক’টি দিন আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি চমৎকার সব হোটেলে আমাদের রেখেছেন এবং বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে আহার করিয়েছেন। আর ব্রেকফাস্ট আমরা প্রতিদিনই হোটেলের রেস্টুরেন্টে বুফেতেই সেরেছি। ইংলিশ স্পিকিং গাইড এবং চমৎকার বাস সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের সঙ্গেই ছিল।

রাতের ফ্লাইটে আমরা ঢাকা থেকে বেইজিং যাই। ভোরে সেখানে পৌঁছানোর পর বিশ্রাম শেষে বাইরে বেরিয়ে লাঞ্চ করি। তারপর শহর পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়ি। আমরা তাদের অলিম্পিক স্টেডিয়াম দেখতে যাই। আরো বেশকিছু স্থান পরিদর্শন শেষে রাতে ট্র্যাডিশনাল হালাল চাইনিজ ফুডের স্বাদ গ্রহণ করি। এরপর হোটেলে ফিরে শান্তির ঘুম!

চীনে দ্বিতীয় দিন। ভোরে হোটেলের রেস্টুরেন্টে জম্পেশ প্রাতরাশ শেষে সদলবলে বেরিয়ে পড়ি। আমরা বাসযোগে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য চীনের মহাপ্রাচীর দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

চীনের মহাপ্রাচীরের ইতিহাস শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, যখন বিভিন্ন রাজ্যের শাসকেরা যাযাবর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রাচীর নির্মাণ শুরু করেন। এই প্রাচীরকে প্রথম সংগঠিত রূপ দেন খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে কিন শি হুয়াং, যিনি বিভিন্ন রাজ্যের প্রাচীরকে সংযুক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে মিং রাজবংশের (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) সময়কালে প্রাচীরের বর্তমান কাঠামোটি নির্মিত হয়, যা মূলত উত্তর দিকের আক্রমণকারীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করত। তথাপি চীন তখনো দুবার বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হয়েছিল।

প্রাচীর নির্মাণের সময় লাখ লাখ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল, কথিত আছে তাদের প্রাচীরের ভেতরেই ইট-সুরকির সঙ্গে মিশিয়ে সমাহিত করা হয়েছিল। এটি একক প্রাচীর নয়, যা সময়ের সঙ্গেই বর্ধিত হয়েছে। এর উচ্চতা ৫-৮ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৮৮৫১.৮ কিলোমিটার।

যাহোক, প্রায় ১টা ৩০ মিনিট যাত্রা শেষে আমরা মহাপ্রাচীরের সন্নিকটে এলাম। সেখানে হাজার হাজার পর্যটকদের ভিড়ে আমাদের ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা হলো। বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমরা কেব্‌ল কারের দোরগোড়ায় উপস্থিত হলাম এবং উড়াল দিয়ে একে একে মহাপ্রাচীরের দেয়ালের বুকে পদযুগল রাখলাম। আর মনপ্রাণ ভরে দুচোখ দিয়ে এর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম, আর আল্লাহকে হাজারবার শোকরানা জানালাম।

এরপর একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের আহার সেরে সুপার মলে ঘোরাঘুরি করি। সন্ধ্যার পর একটি হালাল রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে ক্লান্তশ্রান্ত শরীরে হোটেলে ফিরে এসে সেদিনের মতো ভ্রমণের সমাপ্তি করি।

চীন ভ্রমণের তৃতীয় দিন। সকালে যথারীতি প্রাতরাশ পর্ব সমাপনান্তে গাইডসহ সদলবলে আমাদের বাসে চীনের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটক স্পট নিষিদ্ধ নগরী (Forbidden City) দেখার জন্য রওনা দিলাম। স্থানটি আমাদের হোটেল থেকে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। আজ আমাদের ফরবিডেন সিটি দেখার পর তিন আনমেন স্কয়ারটিও দেখার কথা ছিল। পরের দিন ১ অক্টোবর চীনের ‘ন্যাশনাল ডে’ উপলক্ষে সেটি সব পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই বাসে বসে বসেই কিছুটা দূর থেকে এর স্বাদ নিয়েই খুশি থাকতে হলো।

নিষিদ্ধ নগরী ভিজিটের পরে যথারীতি পূর্বনির্ধারিত হালাল হোটেলে আমাদের জম্পেশ মধ্যাহ্নভোজ সারা হলো। অতঃপর সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন মলে সময় কাটিয়ে রাতের খাবার শেষে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম—ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে।

নিষিদ্ধ শহর বা ফরবিডেন সিটি হলো চীনের বেইজিংয়ের কেন্দ্রস্থলে একটি রাজকীয় প্রাসাদ কমপ্লেক্স, যা মিং এবং চিং রাজবংশের সময়কালে (১৪২০ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত) ২৫ জন সম্রাট, তাদের পরিবার এবং সভাসদের আবাসস্থল ছিল। সাধারণ মানুষের জন্য এই অঞ্চলে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল, যা এটিকে পার্থিব জগতের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করত। বর্তমানে এটি একটি বিশাল প্রাসাদ জাদুঘর এবং চীনের অন্যতম বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র।

China-3

ফরবিডেন সিটি

নির্মাণকাল : ১৪২০ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। মিং (১৩৬৮-১৬৪৪) এবং চিং (১৬৪৪-১৯১১) রাজবংশের সময়কালে এটি চীনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল।

নামকরণ : এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘Purple Forbidden City’, যার অর্থ হলো ‘বেগুনি নিষিদ্ধ শহর’। এটি স্বর্গীয় মেরু নক্ষত্রের ‘Purple Forbidden Enclosure (বেগুনি নিষিদ্ধ প্রাচীর)’-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যা স্বর্গের কেন্দ্র বলে বিবেচিত হতো।

বর্তমান অবস্থা : বর্তমানে এটি ‘নিষিদ্ধ শহর, প্রাসাদ জাদুঘর (Forbidden City – The Palace Museum)’ নামে পরিচিত এবং এটি চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান।

স্থাপত্য : এর নকশা ঐতিহ্যবাহী চীনা স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন, যেখানে ভারসাম্য ও প্রতিসাম্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এটি প্রাচীন চীনা স্থাপত্যের সর্বোচ্চ বিকাশের একটি উদাহরণ।

পর্যটন : এটি বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সংরক্ষিত প্রাসাদ কমপ্লেক্সগুলোর মধ্যে অন্যতম।

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের কেন্দ্রস্থলে তিয়েনআনমেন স্কয়ারকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম পাবলিক স্পট বা জনসমাগম স্থল। নয়া চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং এই তিয়েনআনমেন স্কয়ার থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।

তিয়েনআনমেন স্কয়ারের বিক্ষোভ ছিল ১৯৮৯ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত চীনে অনুষ্ঠিত ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ, যা মূলত গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে শুরু হয়েছিল।

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ ৩-৪ জুন রাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে দমন করা হয়, যা ‘তিয়েনআনমেন স্কয়ার গণহত্যা’ নামে পরিচিত এবং এতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়।

চীনের চতুর্থ দিন। এ বছর ১ অক্টোবর বুলেট ট্রেনে বেইজিং থেকে সকাল ১২টা ৪৭ মিনিটে রওনা হই। সন্ধ্যা ৬টার কিছু পরে আমরা সাংহাই পৌঁছাই। বুলেট ট্রেনে আমার কখনো ওঠা হয়নি, তাই মনের মধ্যে বেশ কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

১ অক্টোবর চীনের ন্যাশনাল ডে ছিল, তাই আমরা সবাই এক কামরায় সিট পাইনি। দু-তিনটি কামরায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আমাদের ৪০ জনের দলটির ঠাঁই হয়েছিল। এতে আমাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। প্রায়ই আমরা এ-কামরা ও-কামরায় চলেফিরে সবার সঙ্গে হাসিগল্পে সময় কাটাচ্ছিলাম।

১ অক্টোবর চীনের জাতীয় দিবসে সুযোগ হলো বেইজিং সাউথ স্টেশন থেকে জি১৩৭ বুলেট ট্রেনযোগে ১ হাজার ২১৪ কিলোমিটার দূরে সাংহাই গমনের। গতিবেগ সীমাবদ্ধ ছিল ঘণ্টায় ৩১২ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত।

এত দ্রুত গতিতে ট্রেনটি চললেও আমাদের কোনোই অসুবিধা হয়নি। কোনো রকম দুলুনি কিংবা ঝাঁকুনি—কিছুই আমরা বিন্দুমাত্র অনুভব করিনি। মনে হচ্ছিল আমরা যেন ঘরে বসেই আমাদের এই যাত্রাটি করছি। এই চমৎকার সফরটি আমার জীবনে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।

সন্ধ্যায় সাংহাই পৌঁছে আমরা আমাদের জন্য সংরক্ষিত বাসে করে আগে থেকেই বুক করা হালাল রেস্টুরেন্টে রাতের আহার সম্পন্ন করি। অতঃপর নির্ধারিত হোটেলে এসে যার যার রুমে রাতে ঘুমাতে চলে যাই।

চীনা বুলেট ট্রেন, যা হাই-স্পিড রেল (HSR) নামে পরিচিত, বিশ্বের দ্রুততম এবং দীর্ঘতম উচ্চগতির রেলওয়ে নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে অন্যতম।

সম্প্রতি, চীন ‘CR450’ নামের একটি নতুন বুলেট ট্রেনের প্রোটোটাইপ উন্মোচন করেছে, যা পরীক্ষামূলকভাবে ঘণ্টায় ৪৫০ কিলোমিটার গতিতে পৌঁছেছে। বাণিজ্যিকভাবে এই ট্রেন ঘণ্টায় ৪০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে।

চীনের দ্রুতগতির রেল (এইচএসআর) হচ্ছে দেশটির যাত্রীবাহী রেলপথগুলোর নেটওয়ার্ক, যেগুলো ২৫০-৩৫০ কিমি/ঘণ্টা (১৫৫-২১৭ মাইল) গতির জন্য নকশা করা। বাণিজ্যিক পরিষেবায় যুক্ত বিশ্বব্যাপী উচ্চ গতির রেল ট্র্যাকের দুই-তৃতীয়াংশ চীনে রয়েছে।

চীনের উচ্চগতির রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বিশ্বের দীর্ঘতম এবং বিশ্বের বেশিরভাগ উচ্চগতির রেল ট্র্যাকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। বেইজিংয়ের দাবি, CR450 আগামীতে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির ট্রেন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। (দ্বিতীয় পর্ব আগামী রোববার)

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত