অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ আর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আমাদের দেশের স্বাধীনতা এসেছে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই স্বাধীনতা অর্জনে নারী-পুরুষ উভয়েরই ত্যাগ ও অবদান অনস্বীকার্য।

শওকত আরা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্রী শওকত আরা। পাবনার আতাইকুলা ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোয় দেশ ও দেশের মানুষ এবং মাটিকে শক্রমুক্ত করার জন্য ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে সর্বাত্মকের প্রতিবাদের মুখে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন শওকত আরা। ১৯৫২ সালের ১ জুলাই রাজশাহীর পদ্মা নদীর পাড়ের পবা উপজেলার হাড়ুপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আহমেদ হোসেন পণ্ডিত ও মা পরিজান বেগমের ১১ ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন শওকত আরা। তার স্বামীর নাম মোহাম্মদ হোসেন জামাল। এই দম্পতির দুই ছেলে—আশেক ওসমান সুহাস ও সাবিদ ওসমান শুভ্র। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন পাবনা শহরের রাধানগরে।
১৮/২০ বছর বয়সি শওকত আরা নিজের চোখে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর হত্যাকাণ্ড দেখেছেন। নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে আটক করে নির্মমভাবে নির্যাতন করত, এরপর হত্যা। তখনই শওকত আরাসহ কয়েকজন সিদ্ধান্ত নেন দেশের জন্য কিছু করবেন। তিনি নিজেকে নারী হিসেবে নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবেই দেখেছেন। মার্চের শেষদিকে রাজশাহীতে স্বাধীনতাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে। ২৬ মার্চের মধ্যে পাকিস্তানি হানাদাররা রাজশাহী কবজা করে ফেলে। অবস্থা দেখে শওকত আরা গ্রামের অন্য নারী-পুরুষদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। বাধ্য হয়ে অস্ত্র ছাড়া লাঠিসোঁটা নিয়ে তারা নেমে পড়েন স্বাধীনতাযুদ্ধে। চারদিকে আতঙ্ক। পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধবিমান থেকে গোলাবর্ষণ ছুড়তে শুরু করে। মেয়েদের যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা দেখে অন্য যোদ্ধারা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রশিক্ষণ শেষে শওকত আরাসহ সবাই মাঠে নেমে পড়েন যুদ্ধ করার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছানোর কাজ শুরু করেন লুকিয়ে লুকিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামের কাছ থেকে গ্রেনেড ছোড়া, রাইফেল চালানো শিখে নেন তারা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এসে জমা হতো গোদাগাড়ীর চব্বিশনগরে। সেখান থেকে অস্ত্র বিলি করা হতো। অস্ত্র সরবরাহের কাজে নিয়োজিত করা হয় শওকত আরাকে। ধরা পড়লেই মৃত্যু, এমনটা জেনেও তারা যুদ্ধে নেমেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শওকত আরার গোপন কর্মতৎপরতার কথা পৌঁছে যায় পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে। তাকে ধরতে উঠেপড়ে লাগে পাকিস্তানি সেনারা, ভাগ্য ভালো বলে বেশ কয়েকবার ধরা পড়তে গিয়েও অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। অক্টোবরের শেষদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ চলে যান। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা কাজে জড়িয়ে পড়েন। পাড়ায় ঘুরে অস্ত্র সংগ্রহ করতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিতেন, লিফলেট বিলি করতেন। ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী শত্রুমুক্ত হলে মুক্ত-স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরা খাতুন।
কলেজের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক হয়েও উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতেন শওকত আরা। তিনি একজন ধর্মপরায়ণ নারী ছিলেন। পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তিনি চাইতেন না মুক্তিযোদ্ধা বলে ওনাকে নিয়ে হইচই বা বাড়াবাড়ি হোক। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কদর পান, এটাও পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, ট্রাংকের ভেতরে বই-খাতার সঙ্গে অস্ত্র গোলাবারুদ রেখেছি। পুলিশ তল্লাশি করতে গিয়ে ধরাও খেয়েছি। তবু দমে যাইনি।’

হাজেরা নজরুল
আন্দোলন-সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ সেই অনেক আগে থেকেই। যেখানে এসব আন্দোলনের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা, তালিকায় নিজের নাম তোলা, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে ব্যস্ত থাকেন অনেকে, সেখানে একেবারেই ভিন্ন ছিলেন সাহিত্য জগতের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মুক্তিযোদ্ধা হাজেরা নজরুল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নিজের নাম রাখেননি বলে নেই গেজেট নম্বরও। ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর রাজবাড়ীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হাজেরা নজরুল। স্কুলজীবন থেকেই তার লেখক জীবনের শুরু। অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন তার মামা এবং শিশু চিকিৎসক আবদুল মুত্তালিব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। বাবা মরহুম ময়েনউদ্দিন আহমেদ ও মা রাহাতুননেসা। নাট্যকার, কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হাজেরা নজরুল ১৯৬২ সালে বায়োকেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে হাজেরা নজরুল সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ওনার স্বামী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম ও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করতেন ঢাকার তেজগাঁও এলাকায়। শহরের অবস্থা খারাপ দেখে স্বামীর সঙ্গে চলে যান শরীয়তপুরের নড়িয়ার উদ্দেশে। গ্রামের তরুণদের যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে শুরু করেন তারা। ট্রেনিং শেষে তারা প্রথম পরিকল্পনা করেন ঢাকার সব বিদ্যুৎ স্টেশনে হামলা করার। পাকিস্তানি বাহিনীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ছোট শিশুদের সঙ্গে নিয়ে শোভাযাত্রা করাতেন। সবার চোখের আড়ালে গিয়ে জরিপ অফিসের ব্লু-প্রিন্ট বের করে নিয়ে আসেন হাজেরা নজরুল। গোপনে গোপনে আশপাশে থেকে চাঁদা তোলার ব্যবস্থা করতেন। চাঁদার টাকা দিয়ে যোদ্ধাদের জন্য কাপড়, খাবার, ওষুধ ইত্যাদি কিনে পাঠাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ জুলাই একসঙ্গে পাঁচটি স্টেশন বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই কাজে হাজেরা নজরুলরা জয় লাভ করেন। এর কিছুদিন পর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে স্বামী নজরুল ইসলাম শহীদ হন।
যুদ্ধের দিনগুলো সম্পর্কে হাজেরা নজরুল বলেন, ‘ও (নজরুল ইসলাম) যখন ওপার বাংলায় কাজ করছিলেন, তখন আমিও দেশের ভেতরে সক্রিয়ভাবে কাজ করছিলাম। প্রতিটি প্রতিবেশীর ঘরে গিয়ে কীভাবে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করতে হবে, সে সম্পর্কে তাদের শিক্ষা দিতাম। সাহস জোগাতাম। শক্তিকবলিত ঢাকা বেতার কেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা ছিল। এ ব্যাপারে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপও হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়নি।’
হাজেরা নজরুলের কর্মজীবনের শুরু হয় সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে গবেষক হিসেবে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত বদরুন্নেসা কলেজে প্রথমে উপাধ্যক্ষ ও পরে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সরকারি বাঙলা কলেজ, ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন। ১৯৯৮ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব হিসেবে নিয়োজিত হন। এখান থেকেই ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে অবসরে যান। এ বছর ৭ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। এই মুক্তিযোদ্ধা দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ে।
লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

