‘আর কোনো ফ্যাসিস্ট সরকার না আসুক’

মোহনা জাহ্নবী
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ৩০

‘কোনোকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি,

প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।’

বিজ্ঞাপন

কাজী নজরুল ইসলামের এই চরণ দুটি আজও খুব প্রাসঙ্গিক। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অনেক অবদান ছিল বলেই বিজয় সম্ভব হয়েছে, তেমনই ২০২৪ সালে নারীর অনবদ্য অংশগ্রহণ ছিল বলেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সফল হয়েছিল। তেমনই এক নারী জান্নাতুল ফেরদৌস ফাতেমা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল আন্দোলনের সময় ছিলেন শরিয়তপুরে। সেখানে একটা অফিসে কর্মরত থাকার দরুন ঢাকা এসে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে না পেরে মন খারাপ লাগছিল তার। তারপর শরীয়তপুরেই শুরু করলেন আন্দোলন। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে লুকিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন তৈরি করতে লাগলেন। তাকে অফিস থেকে সতর্ক করা হচ্ছিল—চাকরি বাঁচাতে চাইলে যেন ফেসবুকে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকেন। তিনিও স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, ‘আমি বাঁচলে, দেশ বাঁচলে, আরও হাজারটা চাকরি করতে পারব।’

আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার প্রথম দিনের স্মৃতিচারণ করে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,“১৮ জুলাই। সবার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, নড়িয়া বিএল স্কুল মাঠে বিকাল ৪টায় সব শিক্ষার্থী থাকবে। আমি অফিস থেকে ৩টায় রওনা হলাম। আমার বাসায় কেউ জানত না, আমি আন্দোলনে যাচ্ছি। আমার স্বামীকে সব বললাম। সে বলল, ‘তোমাকে একা যেতে দেব না, নড়িয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। মোড়ে মোড়ে ছাত্রলীগ টহল দিচ্ছে পুলিশের সঙ্গে। আমিও যাব।’

আমি ও আমার স্বামী ৪টায় বিএল স্কুলের মাঠে পৌঁছালাম। হঠাৎ করে কেউ একজন আমাদের লক্ষ করল। পাশের একটা কোচিং থেকে হঠাৎ ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী বের হলো। তাদের থামালাম। আন্দোলনের ব্যাপারে বোঝালাম। তারাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। আমি আমার বানানো পোস্টার নিয়ে দাঁড়ালাম। পাশে আমার বন্ধুরাও দাঁড়াল। হঠাৎ করে ছাত্রলীগের এক নেতা এসে আমার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলল এবং আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করল। পাশ থেকে কোচিংয়ের শিক্ষার্থীরা সরে গেল। সেই নেতা আমার বন্ধুকেও চড় মারল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন বের করে ভিডিও করার চেষ্টা করলাম। আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল। মুহূর্তেই ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মীরা আমাদের তিনজনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘এই ছেমরিই জান্নাতুল ফেরদৌস ফাতেমা। সেই ফেইসবুকে পোস্ট করেছে—দেশ সংস্কার করব।’ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর লাগাতার কিল, ঘুষি ও লাথিতে আমার ও আমার স্বামীর কয়েক জায়গায় রক্তক্ষরণ হয়। আমার বন্ধুকেও বেদম মারা হয়। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। আমাকে একপর্যায়ে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। আমার স্বামী পরিস্থিতি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে আমাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন লাঠি দিয়ে পিটালে সে পায়ে মারাত্মক ব্যথা পায়। আঘাতের ফলে আমার তলপেট, মাথা ও পিঠে সব জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে যায়। আমার চশমা ভেঙে ফেলে এবং ব্যাগ ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তাতে দুটো ফোন, সরকারি ট্যাব, আইডি কার্ড, এটিএম কার্ড ও নগদ টাকা ছিল। আমার স্বামীর মানিব্যাগ, মোবাইলও নিয়ে যায়। আমরা নিকটস্থ সিটি হাসপাতালে যাই এবং সেখানকার ডাক্তার ও স্টাফদের সহযোগিতায় আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়। আমরা হাসপাতালে ভর্তি হই। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় আমাদের পুরোপুরি চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ছাত্রলীগের নেতারা সেখানেও আমাদের চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে ‘না’ করেন। নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি আমার ব্যাগ উদ্ধার করেন। পুলিশের সদস্যরা নড়িয়া সিটি হাসপাতাল থেকে আমাদের তথ্য নেন এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। বাসায় ফিরে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। ছেলেটা জেনে গেল, সরকার তার মা-বাবাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। ছেলেটার সে কী ঘৃণা! পরেও নানা দিক থেকে আমাদের হুমকি দেওয়া হয়।’

পরদিন নড়িয়া থানায় গিয়ে তিনি ওসির সঙ্গে দেখা করে তার ব্যাগ উদ্ধার করেন। কিন্তু ব্যাগে সরকারি ট্যাব আর আইডি কার্ড ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। ওসি তাকে কোনো মামলা করতে নিষেধ করেন।

জুলাইয়ের বাকি দিনগুলো তাদের গৃহবন্দি হয়ে কাটাতে হয়। কিন্তু ঘরে বসেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব থাকেন জান্নাতুল। তারপর একদিন আসে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট। সকাল থেকে টানটান উত্তেজনা মিডিয়াজুড়ে, সেনাবাহিনীর প্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ততক্ষণে গণভবনে সাধারণ জনগণ প্রবেশ করে ফেলছে। প্রধানমন্ত্রী পালিয়েছে! আমার ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বলল, ‘মা, গভর্মেন্ট নেই। আর কেউ তোমাকে ও বাবাকে মারবে না।’ আমি আমার সন্তানের চোখে নতুন বাংলাদেশ খুঁজে পেলাম। পাশে মা-বোন সবাই। আমাদের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। আমার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। এ যেন নতুন জীবন! নতুন দেশে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়ার স্বাদ।’

জান্নাতুল ফেরদৌসের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আঘাতের ফলে এখনও মাথাব্যথা এবং মারাত্মক রক্ত জমাট হওয়ার ফলে পিঠে ও মেরুদণ্ডে ব্যথা আছে। সম্প্রতি নড়িয়া উপজেলা প্রশাসন আমাকে এ প্রজন্মের যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ইউএনও স্যার আমার চিকিৎসার জন্য চেক দিয়েছেন।’

নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘মানুষ এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে, মন খুলে কথা বলতে পারছে। এটা খুব আনন্দের। এই নতুন দেশে আমার স্বপ্ন—আর যেন কোনো সন্তানকে তার মা-বাবার এমন রক্তাক্ত অবস্থা দেখতে না হয়। অধিকারের জন্য জীবন দিতে না হয়। সবাই সমানভাবে সমান অধিকার পাবে। আর কোনো ফ্যাসিস্ট সরকার না আসুক এই দেশে। নতুন দেশে, নতুন বেশে আসুক সোনার বাংলা—এটাই প্রত্যাশা।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত