জুলাই উইমেন’স ডে

‘নারীদের মতামত ও মেধার মূল্য দেওয়া হয় না’

তনিমা রহমান
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৫, ১১: ৫০

নারীরা একসময় পুরুষদের শক্তি ও সাহস জোগাতেন। আধুনিক নির্ভীক নারীরা এখন শুধু শক্তি ও সাহসই জোগান না, সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেন। বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দাঁড়ান। প্রয়োজনে তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও পিছপা হন না, দ্বিধা করেন না।

বিজ্ঞাপন

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন। নির্যাতিত হয়েছেন। তবে পিছু হটেননি। নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও ত্যাগের বিনিময়ে আজকের ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ। তবে সে সময় নারীরা নিষ্ঠুর অমানুষিক নির্যাতন, অত্যাচার সহ্য করেছেন। তাদের এই সাহস ও ত্যাগের জন্য পুরস্কৃত করার কথা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াসহ নানা জায়গায় তিরস্কৃত হচ্ছেন বলে তারা অভিযোগ করেন। তারা অনেকটা ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন।

গত সোমবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই উইমেন’স ডে’ শিরোনামে বিশেষ আয়োজন করা হয়। আয়োজনে গান, চলচ্চিত্র, স্মৃতিচারণা ও ড্রোন শোর মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে স্মরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা এসব অভিযোগ করেন। কথাগুলো তাদের মুখ থেকেই শোনা যাক।

২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ওপর নির্মমভাবে হামলা করে ছাত্রলীগ। সেদিন অমানবিক হামলার শিকার রক্তাক্ত এক ছাত্রীর ছবি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। সেই ছবির প্রতিকৃতি ‘জুলাই উইমেন’স ডে’ উদযাপন অনুষ্ঠানে ড্রোন শোতে ফুটিয়ে তোলা হয়।

আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও অংশগ্রহণকারী নারীরা মন্তব্য করেন, জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পরও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। তাদের অভিযোগ, ‘এখনো রাজনীতিতে নারীদের উপস্থিতি শুধু প্রতীকীভাবে মেনে নেওয়া হয়, মতামত ও মেধার মূল্য দেওয়া হয় না। বরং সামাজিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে অবমাননার শিকার হতে হয়।’

অনুষ্ঠানে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণা করেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও এনসিপি নেত্রী নুসরাত তাবাসসুম বলেন, চব্বিশের আগেও রাজনীতি করা নারীদের যে চোখে দেখা হতো, এখনো সেই চোখে দেখা হয়। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নারীদের ‘পলিটিক্যাল মেয়ে’ বলে আগের সরকারের আমলে ছোট করা হতো, এখনো তা করা হচ্ছে।’

July-Women's-Day-2

নুসরাত তাবাসসুম আরো বলেন, রাজনীতিতে নারীদের শুধু মিছিলে, আন্দোলনে, ক্যামেরার সামনে দেখানোর জন্য আনা হয়। তাদের মেধার, তাদের মতামতের কোনো দাম নেই। তিনি বলেন, ‘নারীদের কথা বলার লোকও নারীরা, শ্রোতাও নারীরা, এ রকমটা তারা চান না।’

জুলাই-পরবর্তী সময়ে যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছেন, তাদের কথা তুলে ধরেন জুলাই আন্দোলনে আহত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া।

সামিয়া বলেন, যে গোষ্ঠী বেগম রোকেয়া, ইলা মিত্র, প্রীতিলতাকে লাঞ্ছিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার জন্য তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন। এসব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, দেশের সংগ্রামী নারীরা এখনো হাল ছেড়ে দেননি। যে নারীরা পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়েছেন, তাদের লাঞ্ছিত করে, অপমান করে দমানো যাবে না।

জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফসিন মেহনাজ বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায় রয়েছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের কাঁধে। তাই কারো কটাক্ষ, গালি ও নেতিবাচক মন্তব্যকে আমলে নিয়ে পিছু হটা যাবে না। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।

তথ্যচিত্র প্রদর্শন শেষে বিপ্লবী গান নিয়ে মঞ্চে ওঠেন কণ্ঠশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। ‘জুলাইয়ের গল্প বলব বন্ধু’, ‘এই মেয়ে শোন’, ‘আমার নাম প্যালেস্টাইন’, ‘ভয় বাংলায়’—এসব আন্দোলনমুখর গান পরিবেশন করেন তিনি।

‘এই মেয়ে শোন’ গান পরিবেশনের ফাঁকে সায়ান বলেন, ‘মেয়েদের জন্য রাতগুলো নিরাপদ করতে হবে। এই দাবি রাখলাম।’

জুলাইয়ের স্মৃতিচারণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস। জুলাইয়ের ‘আসছে ফাগুনে আমরা হবো দ্বিগুণ’ স্লোগানের কথা মনে করিয়ে দেন।

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এখন শতগুণ, হাজার গুণ। দল থাকবে, মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। তবে নারীর অবমাননা আর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আবার বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাব। কোনো দিন আর এই মাটিতে দ্বিতীয় স্বৈরাচারের আবির্ভাব হবে না।’

শহীদ নাইমা সুলতানার মা আইনুন নাহার অনুষ্ঠানে তার মেয়ের স্মৃতি তুলে ধরেন। আবেগঘন পরিবেশে উঠে আসে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, প্রতিবাদ এবং ত্যাগের গল্প। এরপর প্রদর্শন করা হয় জুলাই-কন্যারা আমরা তোমাদের ভুলব না ও জুলাই অভ্যুত্থানে চোখ হারানো মাহবুব আলমের ওপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্র।

মঞ্চে গান পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী পারসা মাহজাবীন। এরপর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণা করেন আন্দোলনে আহত ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া, আন্দোলনে আহতদের নিয়ে কাজ করা চট্টগ্রামের বাসিন্দা কলি কায়েস, জুলাই আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জের সংগঠক ফারহানা মানিক।

এরপর গান পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী এলিটা করিম ও ব্যান্ড এফ মাইনর। গান শেষে জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করেন জুলাই আন্দোলনের মাদারীপুরের নেত্রী আনিশা। এ সময় তিনি ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় আন্দোলনে আহত নারীরা বিচার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন। এরপর যৌথভাবে জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মালিহা।

এ সময় উমামা ফাতেমা বলেন, এই জুলাই শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের না, গুটিকয় সমন্বয়কের না। জুলাই সবার, সারা বাংলাদেশের। যেখানে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনসহ গত ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মহিলা এবং শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত