ভাসমান জেলেনিদের জীবনসংগ্রাম

গোলাম মোস্তফা
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৫, ১২: ০৬

অভাবের দুঃসহ যন্ত্রণায় নোনা জলের ওপর ভাসমান নৌকাই যেন তাদের ঘরসংসার। নৌকায় বসতবাড়ি—এমন মাছশিকারি জেলেনিদের পরিবারে গতানুগতিক সুখ-দুঃখ ও আশা-নিরাশা থাকলেও লোকালয়ের পল্লিনারীদের জীবনের সঙ্গে এদের জীবনের মিল নেই তেমন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই শ্রেণির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝাতে বলেছিলেন, ‘ওরা গরিবের মধ্যে আরও বেশি গরিব।’

বিজ্ঞাপন

নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) ফেরিঘাটের সন্ধ্যা নদীর তীরে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। ছইওয়ালা টাবুরিয়া নৌকাগুলো মূলত নারীকেন্দ্রিক, যেগুলোর উপার্জনকর্মের মধ্যমণিও নারীপ্রধানরা। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে জীবনধারণের ন্যূনতম উপকরণের সুবিধা থেকে যেখানে অর্ধেকের বেশি পুরুষপ্রধান পরিবার বঞ্চিত, সেখানে নারীপ্রধান পরিবারের দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। নারীপ্রধান পরিবার বলতে বোঝায়, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম কোনো নারী। এসব নারী অধিকাংশই তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা কিংবা অবিবাহিত। এই ভাসমান নারীকেন্দ্রিক জেলেনি পরিবারগুলো এরই একটি বাস্তব চিত্র। এখন আর এ পরিবারগুলো তেমন একটা দেখা যায় না। ক্ষীণভাবে তা টিকে আছে পল্লির বিভিন্ন নদ-নদীতে।

ভাসমান পরিবারগুলোর এক পরিবারপ্রধান কালকিনি উপজেলার কাছিকাটা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বিবি কুলসুম বেগমের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানান, এখানকার প্রতিটি নারীই মেছুয়া। স্বামী কর্তৃক কোনো না কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনায় আজ তারা এ পেশায়। যৌতুকলোভী স্বামীর নির্যাতন, কম বয়সে অভাবী পরিবারে স্বামী-পরিত্যক্ত হওয়া, নদীভাঙন ও একমাত্র উপার্জনকারী স্বামীর মৃত্যুর কারণে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে স্বরূপকাঠির সন্ধ্যানদীর ফেরিঘাট-সংলগ্ন পাড়ে সমবেত হচ্ছেন এ মৎস্যজীবী নারীরা। তাদের মধ্যে কিশোরী, তরুণী, বিবাহিত ও অবিবাহিত বিভিন্ন বয়সের শ্রমজীবী নারী রয়েছেন। বিবাহিত নারী মেছুয়াদের অধিকাংশের সন্তান রয়েছে।

The-life-of-the-fishermen-2

নদী কিংবা সাগরে মাছ শিকার করেই চলে এ সম্প্রদায়ের মানুষের সংগ্রামী জীবন-সংসার। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এ পেশায় জড়িত থাকলেও তাদের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। তারা সবাই মিলে ‘মানতা’ সম্প্রদায় নামে পরিচিত। সাধারণ মানুষের চেয়ে ভাসমান জেলেনিদের জীবনযাত্রা অনেক সংকীর্ণ। ছোট্ট নৌকাটিতেই তাদের জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে, ঘর-সংসার ও পৃথিবী। তবে পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে এসব নারী রোজগারের প্রতি যেমন অতটা সচেষ্ট হতে পারছেন না, তেমনই পারছেন না সন্তানকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার ব্যাপারে। জীবনসংগ্রামে নিয়োজিত এসব মায়ের সন্তানেরা বাধ্য হয়ে অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা-চিকিৎসা, বাসস্থানসহ কোনো মৌলিক চাহিদাই জুটছে না বুভুক্ষু মানতা সম্প্রদায়ের দরিদ্র এসব মানুষের ভাগ্যে।

সন্ধ্যানদীর পাড়ে ৫১টি পরিবারের ৫১টি ছইওয়ালা নৌকায় ১৫৭ সদস্য ভোর হতে না হতেই যে যার মতো মাছের সন্ধানে বিভিন্ন নদ-নদীর উদ্দেশে ছুটছেন তো ছুটছেনই। আবার পড়ন্ত বিকালের শেষ মুহূর্তে লাল সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই তারা নির্দিষ্ট স্থান ফেরিঘাটে এসে হাজির হন। এ দৃশ্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবার অবলোকন করাটা যেন এখানকার মানুষের রীতিমতো নিয়মে পরিণত হয়েছে।

ছইয়াল কোশা নৌকায় রয়েছে সোমত্ত মেয়েও, তবে কখনো বিরূপ কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হন না তারা। ছোট ছোট খাঁচার মধ্যে বাতি জ্বালিয়ে প্রতিটি নৌকায় চলছে রান্নাবান্নার কাজ। নৌকায় ও নদীর চরে বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখে মনে হয় নৌকার মাঝেই যেন তাদের খেলার মাঠ। রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া শেষে কেউবা ছেঁড়া জাল বুনছে, কেউবা গান শুনিয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে, আবার কোনো কোনো নৌকায় দেখা যাচ্ছে পাঁচ-ছয়জন সারিবদ্ধ হয়ে পানের টোপলা মুখে অতীতের গল্পে মেতে উঠেছে। লম্বা কোশা নৌকাটিই যেন তাদের ঘরবাড়ি, থাকা, খাওয়া-দাওয়া, রান্নাবান্না আর আনন্দ-ফুর্তির আবাস। নারীপ্রধান পরিবারগুলোর মধ্যে যেসব পরিবার চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে, ভাসমান জেলেনিরা তারই অন্তর্ভুক্ত। একটু সুখ-সচ্ছলতার আশায় তারা উত্তাল নদীতে মাছ শিকার করেন আজীবন। ছোট ছোট নৌকায় বসবাস করলেও তাদের সংসার ছোট নয়। এ ব্যাপারে পিরোজপুরের আমেনা বেগম জানান, প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে তিন থেকে ছয়টি সন্তান। নৌকাপ্রতি দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি আয় হচ্ছে না। তবে কখনো মাছ বেশি পেলে আয় ভালো হয়, কিন্তু তা মাসে দু-এক দিন।

পরিবার পরিকল্পনার ছোঁয়াই তাদের সমাজে লাগেনি, সুচিকিৎসার অভাবে রোগবালাই তো লেগেই আছে। মানতা সম্প্রদায় শিক্ষিত না হওয়ায় এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে অজ্ঞতার দরুন তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন না, ফলে দিন দিন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাল্য ও বহুবিবাহ তাদের অন্যতম রীতি।

জামালপুরের সুফিয়া বেগম বলেন, একসময় তারা কারেন্ট জাল পেতে জাটকা ধরতেন, তাতে তাদের বেশ আয় হতো। কিন্তু বর্তমানে সুতার জাল দিয়ে মাছ ধরছেন, যে কারণে আগের চেয়ে মাছ কম পাওয়ায় আয়ও কম হয়।

অন্য এক নৌকার মালিক মঙ্গলজান বিবি নৌকার পাশাপাশি তীরে ডেরা তৈরি করে বাস করছেন। ছোট দুই ছেলে ও দুই মেয়ে আর শত বছরের বৃদ্ধা মা মেহের বানুকে নিয়ে তার সংসার। স্বামী মঙ্গল সর্দার ১৮ বছর আগে মারা গেছেন। বড় ছেলে বিয়ে করে বউ-বাচ্চা নিয়ে আলাদা নৌকায় সংসার পেতেছেন। মাছ শিকারের জন্য রোদ-বৃষ্টি ও বন্যার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে অতিকষ্টে কাটছে তার দিনগুলো।

এমনই আরেকটি নৌকা রয়েছে ফরিদপুরের নাজমা বিবির। তার নৌকায় দুই থেকে আট বছরের চারটি শিশুসন্তান রয়েছে। এক বছর আগে এক মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে নাজমা স্বামী-পরিত্যক্ত হয়েছেন যৌতুকের কারণে। গত জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ স্বরূপকাঠির ফেরিঘাটে অবস্থানরত ভাসমান জেলেনিদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। তাদের সহযোগিতায় ১০ হাত একটি ছইয়াল কোশা নৌকা কেনেন। তাদেরই রুটিন অনুযায়ী বিভিন্ন নদ-নদীতে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত হন তিনি। পাঁচ বছরের শিশুটিও নদীতে জাল ফেলার কাজে সহযোগিতা করছে তার মা ও ভাইকে।

এই ভাসমান নারী পরিবারের সন্তানরা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কখনোই নৌকা থেকে কূলে ওঠেন না। নৌকাই যেন বাসস্থানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঘর আর সন্ধ্যার ফেরিঘাটটি যেন তাদের বাড়ি। বেসরকারি এক তথ্যসূত্র অনুযায়ী, এই ভাসমান নারী জেলেনি পরিবার ছাড়াও আমাদের দেশে প্রায় ২৩ লাখ নারীপ্রধান পরিবার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় দুই লাখ নারী শ্রমিক বিভিন্ন কারণে নির্যাতিত ও বিধবা, কিংবা স্বামী-পরিত্যক্ত ও হতদরিদ্র। এসব নারী বিভিন্ন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করে পরিবারের উপার্জনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু নারীকে ভাবা হয় একমাত্র গৃহকর্মের উপযুক্ত, দেওয়া হয় না কাজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক। তারা পান না কাজের নিরাপদ পরিবেশ। তাদের বঞ্চিত করা হয় বিভিন্ন সামাজিক সুবিধা থেকে। আর এভাবে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর অবস্থানে চলে যাচ্ছে এসব নারীপ্রধান পরিবার, শিকার হচ্ছে সামাজিক বৈষম্যের।

মঙ্গলজান বিবি, সুফিয়া বেগম, বিবি কুলসুম, ছকিনা কিংবা নাজমার মতো হাজারো নারী তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রান্তিক অবস্থান থেকে উত্তরণের। আধুনিক সভ্যতার মানুষ যেখানে উন্নত জীবনযাপন করছেন, সেখানে ভাসমান নারী জেলেনিরা অভাবের তাড়নায় পরিবারের প্রধান হিসেবে সংসার চালাতে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি, রৌদ্র কিংবা কনকনে শীতেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন নদীতে। এভাবেই সন্ধ্যা নদীসহ বিভিন্ন নদীতে জেলেনিদের হাসিকান্না জমে থাকে ওই পাঁচহাতি নৌকাতেই, আর নদীর জলে ভেসে ভেসে কেটে যায় তাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জীবন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত