ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প শতরঞ্জি

ওমর শাহেদ
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১৩: ৪৭
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৫, ১৪: ০১

গুলশান আরা রংপুরের জিআই পণ্য শতরঞ্জি বিক্রি করেন। সুন্দর, কালারফুল ও উৎকৃষ্ট ডিজাইনের এই শতরঞ্জিগুলো হাতে না নিলে এগুলোর গুণমান বুঝতেই পারেন না ক্রেতারা। রংপুরের ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব হস্তশিল্পটি নিয়ে তার সঙ্গে অল্পস্বল্প আলোচনা হয়।

আপনার পরিচয়?

বিজ্ঞাপন

আমার নাম গুলশান আরা, বসবাস করি গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের উত্তর ছায়াবীথিতে। ব্যবসার স্থান গাজীপুরে নিজের বাসায়। প্রথমে পরিচিতজনদের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করি এবং এরপর অনলাইনে পেজের মাধ্যমে আমার ব্যবসার পথ চলা। ব্যবসার সূচনা হয় রংপুরের শতরঞ্জি বিক্রি দিয়ে।

রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জির সঙ্গে পরিচয় কীভাবে হলো?

রংপুরের এই শতরঞ্জি আমার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির মাধ্যমে প্রথমে নিজের বাসার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। এরপর এগুলোর ডিজাইন ও কাজ আমার কাছে খুব সুন্দর লাগে। আমি যেখানে থাকি, মানে গাজীপুর, সেখানে আমি কোথাও শতরঞ্জি খুঁজে পাইনি। তখন থেকে মূলত চিন্তা করলাম, আমি উদ্যোগ নিয়ে এ প্রোডাক্ট দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারি।

এই শতরঞ্জিগুলো কেমন বা কী কারণে এগুলো স্পেশাল?

এই শতরঞ্জিগুলোর বিশেষত্ব অবশ্যই আছে। এগুলো এত সুন্দর, কালারফুল আর ডিজাইন এত ভালো যে আপনি এগুলো হাতে না নিলে বুঝতে পারবেন না। শতরঞ্জি মূলত রংপুরের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প। এগুলো হাতে বোনা হয়। স্থানীয় কারিগররা বিভিন্ন ধরনের কাঠের তাঁতযন্ত্র ব্যবহার করে একেকটি শতরঞ্জি তৈরি করেন। আমরা যেমন ছোটবেলায় নকশিকাঁথার গল্প পড়েছি, তেমনি প্রতিটি সেলাইয়ের পেছনে একটি গল্প থাকে। এই শতরঞ্জি আমার কাছে ওই রকমই মনে হয়েছে। এগুলো খুবই কালারফুল হয়। মানে রঙের ব্যবহার খুব সুন্দর হয়। স্পেশাল হওয়ার কারণ হলো এগুলো রংপুরের ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। এটা মেশিনে তৈরি নয়, শিল্পধৈর্য নিয়ে কারিগরের হাতে তাঁতে বোনা। প্রতিটি ডিজাইন ইউনিক। এটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই।

দাম কেমন?

এগুলোর দাম অনেকটা সহনীয় পর্যায়ের। সাইজ অনুযায়ী দাম হয়। বড় সাইজ এক দামের হয়, আর ছোট সাইজগুলো আরেকটু কম দামের হয়। আমার মনে হয়েছে এগুলো দামে সস্তা।

শতরঞ্জি নিয়ে ব্যবসা করবেন, এই সিদ্ধান্ত কেন ও কীভাবে নিলেন?

শতরঞ্জি নিয়ে ব্যবসা করব—এটা আসলে মনের অজান্তে হয়েছে। আমি যখন নিজের জন্য কিনলাম, তখন দেখে খুবই ভালো লাগল। আমার মনে হলো, উদ্যোগ নিয়ে এ প্রোডাক্টটি নিয়ে আসি রংপুর থেকে এবং ব্যবসা শুরু করি। ছোট উদ্যোগ হিসেবে প্রোডাক্টটি ইউনিক লেগেছে। হস্তশিল্প আর ঐতিহ্য নিয়ে তৈরি এই শতরঞ্জি।

একসময় ক্রেতা ছিলেন, এখন বিক্রেতা হলেন। শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল?

একসময় কিনেছিলাম শতরঞ্জি নিজের জন্য, আর এখন আমি বিক্রি করি। আসলে এ ‘শতরঞ্জি’ নামটার সঙ্গে অনেকে পরিচিত নন; তাদের বোঝাতে হয়, এটা ফ্লোরম্যাট বা ওয়ান কাইন্ডস অব কার্পেট। এটাই ছিল শুরু। শতরঞ্জি নিয়ে আমি অনেক সার্চ করেছি। অনেকে বলেন, এটা কটন। আসলে কটন নয়, এটা মখমল সুতার কাজ। মখমল সুতার বিভিন্ন পার্সেন্টেজ আছে। আমি আসলে এটা নিয়ে এখনো বিভিন্ন ইউটিউবে শিখছি।

বিক্রেতা হিসেবে কোন কোন দিকের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়?

যখন আমি বিক্রেতা, তখন কাস্টমারের সঙ্গে আমি আমার বাচ্চাদের মতো ট্রিট করি। আমি তাদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর ততক্ষণ পর্যন্ত দেওয়ার চেষ্টা করি, যতক্ষণ না তারা আমার প্রতি আস্থা স্থাপন করেন। আমি যে প্রোডাক্টগুলো বিক্রি করি, তার গুণগত মান নিশ্চিত করি, যাতে এই কাস্টমার আমার রিপিট কাস্টমার হয়। পণ্যের দাম, সাইজ ও ডেলিভারি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করি। যেহেতু আমি অনলাইনে সেল করি, তাই ছবি, ভিডিও—এগুলো ভালো রেজুলেশন দেওয়ার চেষ্টা করি। বাজার ট্রেন্ড বোঝার চেষ্টা করি।

এই শতরঞ্জিগুলো কারা বানান? তাদের জীবনযাপন কেমন? তাদের জন্য আমাদের কি কিছু করণীয় আছে?

এই শতরঞ্জিগুলো বানান রংপুর অঞ্চলের মাটি আর ঘামে গড়ে ওঠা কারিগররা। বেশিরভাগ কারিগর গ্রামীণ নারী ও পুরুষ। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও তারা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁত দিয়ে পুরো হাতে বোনা শতরঞ্জি। ডিজাইনগুলো তারা নিজেদের মন থেকে করেন, কোনো মেশিন বা প্রিন্ট থেকে নয়। একেকটা শতরঞ্জি তৈরি করতে তিন থেকে দশ দিন পর্যন্ত লাগে। তাদের জন্য অবশ্যই আমাদের করণীয় আছে। আরো অনেককে এ ব্যবসায় এগিয়ে আসতে হবে। এতে তারা আরো বেশি কাজ পাবেন। তাদের প্রাপ্য মজুরি ও সম্মান দেওয়া এবং মিড্‌লম্যান ছাড়া সরাসরি তাদের কাজের মূল্য তুলে ধরা আমাদের কাজ। বিশ্ববাজারে আমাদের এই কারিগরদের হস্তশিল্প তুলে ধরা উচিত।

অনলাইনের আগে সরাসরি কীভাবে পণ্যগুলো বিক্রি করতেন?

অনলাইনের আগে এগুলো আমি বাসা থেকেই সেল করতাম। আমার পরিচিতজন—তাদের পরিচিতজন, এভাবে সার্কেলওয়াইজ আমি সেল করেছি। তবে আমার এখন ইচ্ছা আছে বিভিন্ন মেলাগুলো হয়, সেখানে অংশগ্রহণ করব, যাতে প্রোডাক্টগুলো কাস্টমারদের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়।

অনলাইনের দিকে কীভাবে ও কেন ঢুকলেন? সেখানে ব্যবসা কেমন হচ্ছে?

এখন তো ফেসবুক খুললেই বিভিন্ন প্রোডাক্টের অ্যাড দেখা যায়। আমি নিজেও অনেক প্রোডাক্ট অনলাইনে কিনি। অনলাইন এখন ফিঙ্গার স্টেপস। ব্যবসা আলহামদুলিল্লাহ ভালো, ঈদ গেছে-আমার প্রোডাক্টও ভালো বিক্রি হয়েছে। আমি শতরঞ্জির পাশাপাশি টেবিল রানারও সেল করি।

অনলাইনে পণ্য কেনার ঠিকানা কী?

অনলাইনে আমার একটা পেজ আছে, সেটার নাম ক্রাফটি টাচ।

এ ব্যবসায় আপনার সমস্যাগুলো কী কী? সেগুলো কীভাবে দূর করা যায়?

যেহেতু আমি অনলাইনে বিজনেস করি, তাই এখানে পেজের মাধ্যমে টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগে। তা ছাড়া ফেসবুকে পোস্টিংয়ে ইনভেস্ট করতে হয়। এই শতরঞ্জিতে কাস্টমাইজ করা যায় না এখন পর্যন্ত। পণ্যের সাইজ ও ডিজাইন না মিললে অর্ডার মিস হয়। মাঝে মাঝে ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই মিস হয়ে যায়। কারিগরের অনুপস্থিতির জন্য প্রোডাকশন থেমে যায়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?

আমার পরিকল্পনা অনেক বড়। আমার ব্র্যান্ড ক্রাফটি টাচকে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড হিসেবে তৈরি করতে চাই। আমি এই বিজনেসকে অনেক বেশি সম্প্রসারিত করতে চাই, যাতে আরো বেশি কারিগর কাজের সুযোগ পায়। প্রত্যেক কারিগরের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের সঠিক মূল্য দিতে চাই। এই ব্যবসা ই-কমার্স এবং এক্সপোর্ট হিসেবে দাঁড় করাতে চাই। এই জিআই প্রোডাক্টকে আন্তর্জাতিকভাবে এক্সপোর্ট করার ইচ্ছা আছে আমার। আমার লক্ষ্য হলো ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা প্রতিটি শতরঞ্জি যেন গর্বের প্রতীক হয়, ঐতিহ্যের বাহক হয়। আল্লাহ সহায় হোন। দোয়া করবেন সবাই।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত