বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষা কেন প্রয়োজন

মো. সাখাওয়াৎ হোসেন
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ২৮

দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং একাডেমিক প্রতিযোগিতার আধুনিক যুগে, বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থা একাডেমিক উৎকর্ষতা এবং চরিত্র বিকাশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সংগ্রাম করছে। বাংলাদেশে, শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগ্রাম বিশেষভাবে স্পষ্ট, যেখানে মূলত সাক্ষরতা এবং সংখ্যাবিদ্যার ওপর জোর দেওয়া হয়। যদিও এই মৌলিক দক্ষতাগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাথমিক পাঠ্যক্রমগুলোয় নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি বা অবমূল্যায়ন শিশুদের সামগ্রিক বিকাশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় নৈতিক শিক্ষা প্রবর্তন এবং শক্তিশালীকরণ শুধু কাম্য নয়Ñএটি অপরিহার্য।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান অবস্থা

প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি করেছে। প্রায় ৯৭ শতাংশ নেট ভর্তির হারের সঙ্গে, দেশটি সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের দিকে এগিয়ে গেছে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, উপবৃত্তি এবং মধ্যাহ্নভোজের মতো সরকারি উদ্যোগগুলো এই সাফল্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। তবে, এই প্রচেষ্টাগুলো মূলত সাক্ষরতার হার এবং একাডেমিক অর্জন বৃদ্ধির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, নৈতিক শিক্ষা ও নৈতিক উন্নয়নের ওপর খুব কম জোর দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের লক্ষ্যে কিছু বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করলেও, এগুলো প্রায়ই বিচ্ছিন্ন পাঠ বা অধ্যায়ে উপস্থাপন করা হয়, যার মধ্যে একীকরণ এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের অভাব থাকে। ফলে, শিক্ষার্থীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে নৈতিক মূল্যবোধগুলো আত্মস্থ না করে বা অনুশীলন না করেই মুখস্থ করতে পারে।

প্রাথমিক পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব

নৈতিক শিক্ষা বলতে সততা, দয়া, দায়িত্ব, শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতির মতো মূল্যবোধের শিক্ষাকে বোঝায়। দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি এবং একটি সুসংহত সমাজ গঠনের জন্য এগুলো অপরিহার্য গুণাবলি। প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা একটি শিশুর ভবিষ্যৎ বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করে, এই মূল্যবোধগুলো প্রবর্তন এবং শক্তিশালী করার আদর্শ পর্যায়।

মনোবিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদরা একমত যে প্রাথমিক বছরগুলো চরিত্র গঠনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়, শিশুরা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয় এবং তাদের আচরণ, মনোভাব ও বিশ্বাস তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা গঠিত হয়। যদি এই পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষাকে পদ্ধতিগতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে শিশুরা একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে আর্থসামাজিক বৈষম্য, দুর্নীতি এবং সামাজিক অস্থিরতা ব্যাপক, নৈতিক শিক্ষা আরো জরুরি হয়ে উঠেছে। অল্প বয়স থেকেই সততা, সহনশীলতা এবং নাগরিক দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈতিক শিক্ষার সুবিধা

১. দায়িত্বশীল নাগরিক গড়ে তোলা

নৈতিক শিক্ষা শিশুদের সঠিক ও ভুলের পার্থক্য করতে এবং তাদের কর্মের পরিণতি বুঝতে সাহায্য করে। এটি অন্যদের প্রতি কর্তব্যবোধ জাগিয়ে তোলে এবং এমন আচরণকে উৎসাহিত করে, যা সমগ্র সমাজের জন্য উপকার। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টারত একটি দেশে, অল্প বয়স থেকেই দায়িত্বশীল নাগরিকদের প্রতিপালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

child
child

২. শ্রেণিকক্ষের আচরণ এবং শৃঙ্খলা উন্নত করা

নৈতিক শিক্ষার তাৎক্ষণিক প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নত আচরণ। যখন শিশুদের তাদের সহকর্মী, শিক্ষক এবং স্কুলের সম্পত্তিকে সম্মান করতে শেখানো হয়, তখন এটি আরো সুশৃঙ্খল ও সুখকর শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ তৈরি করে। এর ফলে, শিক্ষণ-শিক্ষণ প্রক্রিয়া উন্নত হয়।

৩. সহিংসতা এবং বুলিং হ্রাস

বাংলাদেশের স্কুলগুলোয়, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, বুলিং, আগ্রাসন এবং অসম্মানের মতো আচরণগত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নৈতিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহানুভূতি, দয়া এবং বোধগম্যতা বৃদ্ধি করে এই সমস্যাগুলো সমাধানে সহায়তা করতে পারে।

৪. বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি

বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত গোষ্ঠীর আবাসস্থল। সহিষ্ণুতা, অন্তর্ভুক্তি এবং পার্থক্যের প্রতি শ্রদ্ধার মতো মূল্যবোধ শিক্ষা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমাতে এবং সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। নৈতিক শিক্ষা এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫. সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা বৃদ্ধি

নৈতিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের নৈতিক দ্বিধা সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলকভাবে চিন্তা করতে এবং তথ্যবহুল সিদ্ধান্ত নিতে প্রশিক্ষণ দেয়। এটি প্রতিফলন এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতাকে উৎসাহিত করে, যা ব্যক্তিগত ও পেশাগত উভয় জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ।

নৈতিক শিক্ষা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সত্ত্বেও, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় নৈতিক শিক্ষা বাস্তবায়ন বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়Ñ

ক. অতিরিক্ত পাঠ্যক্রম

বর্তমান প্রাথমিক পাঠ্যক্রম ইতোমধ্যেই বিষয় এবং বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ। শিক্ষকরা প্রায়ই পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ হন, যার ফলে নৈতিক শিক্ষার জন্য খুব কম সময় থাকে।

খ. প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব

বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নৈতিক শিক্ষা প্রদানের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নন। ফলে, নৈতিক মূল্যবোধ প্রায়ই ভাসাভাসা বা তাত্ত্বিকভাবে শেখানো হয়।

গ. মূল্যায়ন সীমাবদ্ধতা

ঐতিহ্যবাহী পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করে নৈতিক শিক্ষা সহজে পরিমাপ করা যায় না। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপকভাবে পরীক্ষাকেন্দ্রিক এবং যেসব বিষয় পরীক্ষা নেওয়া হয় না বা কম নেওয়া হয়, সেগুলো প্রায়ই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের কাছ থেকে কম মনোযোগ পায়।

ঘ. মিডিয়া এবং সমাজের প্রভাব

আজকের শিশুরা বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া প্রভাবের মুখোমুখি হয়—যার মধ্যে অনেকগুলো বস্তুবাদ, সহিংসতা বা অসম্মানকে উৎসাহিত করে। সঠিক নির্দেশনা ছাড়া, এই প্রভাবগুলো স্কুলে শেখা নৈতিক পাঠগুলো অতিক্রম করতে পারে।

কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ

এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে এবং বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার একটি অর্থবহ অংশ হিসেবে নৈতিক শিক্ষা তৈরি করতে বেশ কয়েকটি কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেÑ

১. নৈতিক শিক্ষাকে বিদ্যমান বিষয়গুলোয় একীভূত করা

নৈতিক শিক্ষাকে একটি পৃথক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার পরিবর্তে, এটি ভাষা, সামাজিক অধ্যয়ন এবং ধর্মীয় শিক্ষার মতো বিদ্যমান বিষয়গুলোয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। নৈতিক পাঠগুলো তুলে ধরার জন্য গল্প, বাস্তব জীবনের উদাহরণ এবং দলগত আলোচনা ব্যবহার করা যেতে পারে।

২. শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা

নৈতিক মূল্যবোধ কার্যকরভাবে শেখানোর জন্য শিক্ষকদের দক্ষতা এবং সম্পদ দিয়ে সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। নিয়মিত কর্মশালা, প্রশিক্ষণ অধিবেশন এবং শিক্ষণ উপকরণের বিকাশ এই প্রচেষ্টাকে সফল করতে পারে।

৩. গল্প বলা এবং ভূমিকা পালনের ব্যবহার

শিশুরা গল্প এবং অভিজ্ঞতামূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে সবচেয়ে ভালো শেখে। ভূমিকা পালন, বিতর্ক এবং গল্প বলার অধিবেশন শিক্ষার্থীদের মজাদার এবং আকর্ষণীয় উপায়ে নৈতিক ধারণাগুলো বুঝতে এবং আত্মস্থ করতে সাহায্য করতে পারে।

৪. অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা

নৈতিক শিক্ষা শুধু স্কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বাড়িতে মূল্যবোধ জোরদার করার ক্ষেত্রে পিতা-মাতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্কুলগুলো তাদের সন্তানদের নৈতিক বিকাশে পিতা-মাতাদের সম্পৃক্ত করার জন্য কর্মশালা এবং সচেতনতা প্রচারণার আয়োজন করতে পারে।

৫. মূল্যবোধভিত্তিক স্কুল সংস্কৃতি তৈরি করা

স্কুলগুলো তাদের লক্ষ্য অনুসারে মূল্যবোধগুলো শেখানো উচিত। সম্মান, ন্যায্যতা এবং সহযোগিতা ধারণ করে এমন একটি ইতিবাচক স্কুল পরিবেশ স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের এই আচরণগুলো গ্রহণ করতে উৎসাহিত করবে।

৬. প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা

ইন্টারেক্টিভ গেম, কুইজ এবং ভিডিওর মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধ শেখানোর জন্য ডিজিটাল সরঞ্জাম এবং শিক্ষামূলক অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। এই সরঞ্জামগুলো তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য নৈতিক পাঠগুলো আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।

বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে অতিরঞ্জিত বলা যায় না। দেশটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিক্ষার অ্যাক্সেসে অগ্রগতি অব্যাহত রাখার সঙ্গে সঙ্গে, ভবিষ্যতের নাগরিকদের চরিত্র এবং বিবেক গঠনেও বিনিয়োগ করতে হবে। আধুনিক বিশ্বের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য শুধু একাডেমিক জ্ঞানই যথেষ্ট নয়; শক্তিশালী নৈতিকতাসমৃদ্ধ জাতিও প্রয়োজন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈতিক শিক্ষার প্রবর্তন এবং জোরদারকরণ শুধু দুর্নীতি, অসহিষ্ণুতা এবং সহিংসতার মতো সামাজিক সমস্যাগুলো হ্রাস করতে সহায়তা করবে না বরং ন্যায়বিচার, সহানুভূতি ও নাগরিক দায়িত্বের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখবে। আর এমন একটি প্রজন্ম তৈরিতেও অবদান রাখবে। একটি উজ্জ্বল আরো স্বস্তিকর বাংলাদেশের জন্য, ভিত্তি স্থাপন করতে হবে এর শ্রেণিকক্ষে এবং এটি এ দেশের শিশুদের দিয়ে শুরু করতে হবে।

অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন)

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

গভীর রাতে বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে ওএমএসের চাল বিক্রির অভিযোগ

শপথ নিলেন পিএসসির নতুন সদস্য আফতাব হোসেন

মোটরবাইক নিষেধাজ্ঞায় বিলিয়ন ডলারের বাজার হারানোর শঙ্কায় ভিয়েতনাম

বিএনপি নেতার চাপে জুলাই হত্যা মামলার দুই আসামিকে ছেড়ে দিলেন ওসি

সাবেক আইজিপি মামুন অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বাঁচার চেষ্টা করছেন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত