সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত সর্বাত্মক অবরোধের দিনটি নজিরবিহীন সহিংসতায় পরিণত হয়। সারা দেশে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে কমপক্ষে ২৭ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১১ জন শিক্ষার্থী, একজন সাংবাদিক, দুজন রিকশাচালক, একজন পথচারী ছিলেন। বাকিদের পরিচয় অজানা। এদিন ঢাকায় সর্বাধিক ১৯ জন নিহত হন। চট্টগ্রাম, নরসিংদী, মাদারীপুর, সিলেট, রংপুর ও ঢাকার সাভারে আরো আটজন প্রাণ হারান। নিহতদের অধিকাংশের শরীরে গুলি ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়।
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১১ জন মারা যান। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয়জনের লাশ আসে, যাদের মধ্যে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আসিফ ও সাকিলসহ চারজন ছিলেন। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চারজন এবং উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে একজন মারা যান।
ধানমন্ডিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ মারা যান। তার শরীরে রাবার বুলেটের ক্ষত ছিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচজনের লাশ আসে, যাদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক হাসান মেহেদী, রিকশাচালক ওয়াসিম, তরুণ নাজমুল ও গুলিতে নিহত মোহাম্মদ। রামপুরায় দুজন নিহত হলেও তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সাভারে রাবার বুলেটে মিরপুরের এমআইএসটির ছাত্র শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন নিহত হন। নরসিংদীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাহমিদ তামিম এবং মো. ইমন মিয়া প্রাণ হারান।
মাদারীপুরে ছাত্রলীগ ও পুলিশের ধাওয়া থেকে পালানোর সময় দীপ্ত দে লেকে পড়ে মারা যান। তিনি প্রাণিবিদ্যার ছাত্র এবং কোটা আন্দোলনের স্থানীয় সমন্বয়ক ছিলেন। সিলেট ও রংপুরে আরেক শিক্ষার্থী এবং এক রিকশাচালক নিহত হন।
১৯ জুলাই সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগে রাজধানী ঢাকাসহ ৩১ জেলা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে সারা দেশে মোট নিহতের সংখ্যা বলা হয় ১০৩ জন, আহত দেড় হাজারের বেশি। কিন্তু হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি। রাতেই কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে।
সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক (বর্তমানে কারাগারে) প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি আয়োজনের পরিকল্পনা করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেন। শিক্ষামন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিলেও শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়। পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট ও গুলিতে বহু মানুষ আহত ও নিহত হন। রাজধানী ঢাকায় ১২০ জন আহত হন এবং সংঘর্ষ রাত পর্যন্ত চলে। পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কঠোর দমন অভিযানে ২৪৭ জনকে আটক করা হয়।
আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের সংলাপ প্রস্তাবকে ‘প্রহসন’ বলে প্রত্যাখ্যান এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংসতায় পরিণত করার অভিযোগ করেন। তারা আন্দোলন দমন বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিন ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও নিহতের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন চলাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দেশজুড়ে শতাধিক জায়গায় সরকারি দপ্তর ও দলীয় কার্যালয়ে হামলা হয়।
দিনটি বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়।

