মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৫, ০৬: ৩৬

কোটা সংস্কার আন্দোলন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ থেকে এক রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল। চারদিনের ব্যবধানে পুলিশের গুলি, হামলা ও সহিংসতায় প্রাণ হারান অন্তত ১৪৮ জন। শুধু ২১ জুলাইয়েই সরকারি হিসাবে নিহত হন ২৬ জন। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ২১ জুলাই রাজধানীসহ সারা দেশে মাদরাসা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, নিহতও হয়েছিলেন অনেকে।

এ কারণে ২১ জুলাই ‘মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে নানা আয়োজনে দিনটি স্মরণীয় করে রাখার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আলোচনা সভা ও ঐতিহাসিক চেতনা পুনর্জাগরণের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন আয়োজকরা।

বিজ্ঞাপন

শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এ প্রসঙ্গে গত ১৭ জুলাই বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাহসী প্রতিরোধই আজকের নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেছে। যাত্রাবাড়ীতে ‘যাত্রাবাড়ী প্রতিরোধ দিবস’উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে তিনি উল্লেখ করেন, শোষণ ও বৈষম্যহীন এক বাংলাদেশের স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়ে মাদরাসা ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিলেন। এ আত্মত্যাগ আর ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের চেতনা শুধু অতীতের গৌরব নয়, বরং ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা। ‘প্রতিরোধ দিবস’-এর এ আয়োজন তাই শুধু স্মরণ নয়, বরং মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অবদানকে জাতীয় ইতিহাসে যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক প্রয়াস।

২১ জুলাই পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়Ñময়মনসিংহ, গাজীপুর, সাভার ও নরসিংদীতে বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঢাকায় নিহতদের মধ্যে ১৫ জনের পরিচয় জানা গিয়েছিল হাসপাতাল সূত্রে । বাকিদের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায় তাদের পরিবারের কাছ থেকে। নিহতদের অধিকাংশ ছিলেন তরুণ-যুবক, একজন কিশোর এবং দুজন পুলিশ সদস্যও সেদিন নিহত হন। তাদের শরীরে গুলির চিহ্ন, রাবার বুলেটের ক্ষত এবং মারধরের আঘাত ছিল।

টানা কারফিউ ও সেনা মোতায়েন করে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, বাড্ডা, মিরপুর ও উত্তরা- এসব এলাকায় সেনা-পুলিশ-র‍্যাব আন্দোলনকারীদের ওপর চালিয়েছিল ব্যাপক নির্মমতা। যাত্রাবাড়ীতে মাদরাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা গড়ে তুলেছিলেন ঐতিহাসিক প্রতিরোধ। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট এবং প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র।

২১ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪ জনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়, যাদের মধ্যে ট্যুরিস্ট পুলিশের এসআই মুক্তাদির এবং ডিএমপির নায়েক গিয়াসউদ্দিনও ছিলেন। গিয়াসউদ্দিনের লাশ যাত্রাবাড়ীর ফুটওভারব্রিজের নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিভিন্ন এলাকা থেকে আরো অনেক লাশ হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন নারায়ণগঞ্জের ছাত্র ইমাম হাসান তায়িম, কিশোর শুভ এবং যুবক আব্দুল্লাহ আবির। ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহে নিহত হন গৌরীপুর ও ফুলপুরে চারজন, সাভারে মুরগি ব্যবসায়ী কোরবান আলী, শ্রমিক মেহেদী হাসান, শিক্ষার্থী সাদ মাহমুদ ও রিকশাচালক রনি। গাজীপুর ও নরসিংদীতেও মৃত্যু ঘটে আন্দোলনকারীদের।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলামকে ডিবিপুলিশ পরিচয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা আগেই তুলে নিয়েছিল। পরে আরো তিন সমন্বয়কÑসারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও হাসিব আল ইসলামকে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গেই গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবি পুলিশ ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ গ্রেপ্তারের দায় অস্বীকার করেছিল।

সেদিন বিক্ষোভ দমন করতে সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন, কারফিউ এবং ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়। মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট তিনদিনের বেশি সময় অচল ছিল, যার কারণে জরুরি সেবা এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ইন্টারনেট বন্ধ রেখে বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো হয়েছিল নৃশংসতা।

সরকার প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র বলে চালাতে চেয়েছিল, অথচ মাঠে ছিল কিশোর, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মাদরাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার, গুম এবং সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়ার নাটক সাজিয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের দায়ী করা হয়।

মহাখালীতে সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে সরকারের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীরা আগুন ও ভাঙচুর চালায়। পরে এর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। সরকারি বাহিনী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে এ হামলাকে ‘ছাত্রদের কাজ নয়’ বলেও উল্লেখ করা হয়। অথচ সে পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই ছাত্রদের ওপর সেনা-র‍্যাব নামিয়ে দেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্ট ২১ জুলাই কোটা পুনর্বহালের পক্ষে রায় দিলেও সরকার সেটিকে লিভ টু আপিলের মাধ্যমে ঠেকানোর চেষ্টা চালায়।

আন্দোলনের সমন্বয়করা আট দফা দাবি নিয়ে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন, যেখানে নিহতদের বিচার ও ক্ষতিপূরণ, চাকরিতে নিরাপত্তা, কোটা সংস্কারে সংসদে আইন পাসের দাবি তুলে ধরা হয়। পরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম নেতা আবদুল কাদের জানান, আন্দোলনের মূল সংগঠকদের দিয়ে জোর করে বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছিল।

আন্দোলনের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, ৩০০ জনের বেশি নিহত হওয়ার তথ্য রয়েছে এবং সরকারের মিথ্যা বিবৃতি, সেনা-মিডিয়া ব্যবস্থাপনায় এ গণহত্যা আড়াল করা যাবে না। জাতিসংঘ, ইইউ ও ব্রিটেন এ সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত