সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কটূক্তি করেন। এর প্রতিবাদে সেদিন ফুঁসে উঠছিলেন শিক্ষার্থীরা। গত বছরের ১৪ জুলাই মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন তারা। কটূক্তির প্রতিবাদে টিএসসি এলাকায় জড়ো হয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন। একই সময় জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলন হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে রাত ১০টার পর থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে ফেসবুক গ্রুপ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ’-এর আহ্বানে তারা হল থেকে বের হয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন। সেদিন সেখানে তারা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’সহ নানা স্লোগান দেন। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারীরাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অংশ নেন।
বিক্ষোভ চলাকালে মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সেদিন হলে হলে বিক্ষোভ রুখতে সংগঠনটির ক্যাডাররা শিক্ষার্থীদের বাধা দেন।
এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অন্যায্য কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলায় আমাদের অপমান করা হয়েছে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। আমরা সেটা মেনে নিতে পারিনি।’ আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, প্রতিবাদ ঠেকাতে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চবিতে ছাত্রলীগের হামলা
সেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হামলা চালায়। ১৪ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড় সড়কে এ হামলা চালানো হয়। এতে এক নারী শিক্ষার্থীসহ অন্তত দুজন আহত হন।
এর আগে রাত সোয়া ১১টার দিকে চবির জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের চার-পাঁচজন ক্যাডার সেখানে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে হঠাৎ কয়েকটি বোমা ফোটায়। এতে ভীত হয়ে শিক্ষার্থীরা পিছু হটেন। পরে আন্দোলনকারীরা কাটা পাহাড় সড়ক হয়ে শহীদ মিনারের দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা তাদের ধাওয়া দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এ সময় অন্তত চার-পাঁচজন শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়।
হামলার পর রাত ১টা পর্যন্ত ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই ঘটনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জবিতেও মধ্যরাতে বিক্ষোভ
একই দাবিতে ১৪ জুলাই রাত ১২টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেন। তারা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড় পর্যন্ত যান এবং পরে আবার ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন।
বিক্ষোভকারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এসব বিক্ষোভ তাদের ব্যানারের ঘোষিত কর্মসূচি ছিল না। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ জায়গা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদে নেমেছেন। তবে ঢাকায় রাজু ভাস্কর্যের কর্মসূচিতে সংগঠনটির নেতাদের সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে দেখা গেছে।
রাষ্ট্রপতিকে আলটিমেটাম
সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার এবং শাহবাগ থানায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সেদিন সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। ১৪ জুলাই ঢাকায় রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান এবং গুলিস্তানে অবস্থান কর্মসূচি থেকে তারা এই সময়সীমা ঘোষণা করেন।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গভবন অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পথে শাহবাগ, মৎস্য ভবন, সচিবালয়ের সামনে ও জিপিও মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তারা গুলিস্তান পৌঁছান। সেখান থেকে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের হাতে স্মারকলিপি জমা দেয়।
বেলা ৩টায় গুলিস্তানে ফিরে এসে আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সমাবেশে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে আমরা দাবি জানিয়েছি, তিনি যেন জরুরি সংসদ অধিবেশন ডেকে কোটার যৌক্তিক সংস্কার বিষয়ে আইন পাসের ব্যবস্থা করেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ২৪ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না থাকলে কঠোর কর্মসূচিতে যাব।’
পদযাত্রা চলাকালে বিভিন্ন মোড়ে পুলিশের বাধা ও ব্যারিকেড ভেঙে শিক্ষার্থীরা ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’—এমন স্লোগানে রাজপথ কাঁপান। জিরো পয়েন্ট এলাকায় যান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে।
মামলা প্রত্যাহার দাবি
শাহবাগ থানায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মামলাটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহারের দাবি জানান আন্দোলনকারীরা। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা আরো ২৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে দিচ্ছি। এরপর মামলা প্রত্যাহার না হলে কঠোর কর্মসূচি হবে।’
ঢাকার বাইরেও তীব্র প্রতিক্রিয়া
একই দিন ঢাকার বাইরেও অন্তত ১৭টি জেলায় শিক্ষার্থীরা পদযাত্রা ও বিক্ষোভ করেন। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, পাবনা, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘণ্টাব্যাপী পদযাত্রা, জাহাঙ্গীরনগরে সংহতি সমাবেশ এবং অন্যান্য জেলাতেও দিনভর শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। প্রতিটি কর্মসূচিকে ঘিরে পুলিশের বাড়তি উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
আন্দোলনের ১৪তম দিনে স্মারকলিপি ও সময়সীমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের নতুন ধাপের সূচনা করেছিলেন শিক্ষার্থীরা।

