ইন্টারনেট বন্ধ করে গণহত্যা চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২৫, ০৬: ৪৫
ছবি: সংগৃহীত

২২ জুলাই, ২০২৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ও বেদনাবিধুর এক দিন। টানা তিনদিন ধরে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে জনগণকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল শেখ হাসিনার সরকার। এর মাঝেই গণহত্যা চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। পাশাপাশি ছিল ধরপাকড় ও লাশ গুম। কারফিউ সামান্য শিথিল হলেও রাজধানীসহ সারা দেশে; বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, শেরেবাংলা নগর, মিরপুর, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেনা, পুলিশ ও সাদা পোশাকধারীদের দমন-পীড়ন চলতে থাকে। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ অন্তত ২১ জন নিহত হন। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী, মাদরাসাছাত্র, বিক্ষোভকারী ও সাধারণ পথচারীদের ওপর চালানো হয় গুলি, গ্রেপ্তার ও চরম নির্যাতন। ঢাকায় দেখা যায়, স্বজনের লাশ খুঁজতে পথে পথে ছুটছিলেন মানুষ, হাসপাতালে ছড়িয়েছিল রক্তাক্ত দেহ।

সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সার্কুলার জারি করলেও আন্দোলনকারীরা ওই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করেন। রাতে কারফিউ শিথিলের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে ২৪ জুলাই দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত করা হয়। ঢাকা ও গাজীপুর জেলা ও মহানগর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় এ সময়সীমা কার্যকর ছিল। ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ ঘোষণা দেন।

বিজ্ঞাপন

সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের ছাত্র তানজিম সিজন গুলিবিদ্ধ হন। বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায় পুলিশের অভিযানের সময় তার মাথায় ছররা গুলি লাগে। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি সাংবাদিকদের জানান, তিনি মেসে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ পুলিশ জানালা দিয়ে গুলি ছোড়ে এবং তা তার মাথায় লাগে।

ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা ধাপে ধাপে চালু করা হয়। ২২ জুলাই অগ্রাধিকারভিত্তিতে আংশিক চালুর পর ২৪ জুলাই থেকে সম্পূর্ণরূপে চালু করা হবে বলে জানানো হয়।

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকায় বড় ধরনের গ্রেপ্তারের ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন জায়গায় বিরোধী দলের নেতা ও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় চলছিল। বিভিন্ন স্থানে অভিযান, গ্রেপ্তার এবং সহিংসতার ফলে ২৩ জুলাইও বেশকিছু মানুষ নিহত হন।

এদিকে, কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস উপায়ে দমনের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর জন্য উল্টো বিএনপি-জামায়াতকে সরাসরি দায়ী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই রাজনৈতিক জোট সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং পরিকল্পিতভাবে দেশব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘জামায়াত-শিবির পেছন থেকে সারা দেশে নাশকতা চালিয়েছে আর বিএনপি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এবার কাউকে সহজে ছাড় দেওয়া হবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ইতোমধ্যে তা শুরু হয়েছে।’

সরকারের পক্ষ থেকে কারফিউ জারি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন এবং সেনাবাহিনী ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা নিয়েও বক্তব্য দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দাবি উপস্থাপন করছিল। তারা আমাদের সবচেয়ে সংবেদনশীল শ্রেণি। আমরা চেয়েছি তাদের কোনো ক্ষতি না হোক। সহিংসতা শুরু হলে তারাই বলেছে, তারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এবং নিন্দাও জানিয়েছে। আন্দোলনের ছায়াতলে থেকে বিএনপি-জামায়াত চক্র দেশের সম্পদ, স্থাপনাগুলো এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করতে সুপরিকল্পিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে।’

সেদিন ব্যবসায়ী নেতারাও প্রধানমন্ত্রীকে একবাক্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান। এতে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিনসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।

রক্তাক্ত যাত্রাবাড়ী

১৬ জুলাইয়ের পর থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা তিন শতাধিকে পৌঁছায়। এর মধ্যে অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকরা। ওই গণহত্যা ছিল শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের নির্মম নিদর্শন।

চলমান ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠা যাত্রাবাড়ী এলাকা পাঁচ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ২২ জুলাই সেনাবাহিনী ও পুলিশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল-চিটাগাং রোড পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সেনা ও পুলিশ সদস্যদের টহল জোরদার করা হয়।

২২ জুলাই বিকালে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সরেজমিন যাত্রাবাড়ী পরিদর্শনে যান। তাদের সঙ্গে ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার তৎকালীন প্রধান মনিরুল ইসলাম, র‍্যাব মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ এবং ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, এই সহিংসতায় যারা অংশ নিয়েছে, তাদের প্রতিটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য আইনের আওতায় এনে জবাবদিহি করানো হবে।

তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান অভিযোগ করেন, ‘ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসীরা এসে এখানে ঘাঁটি গেড়েছে। পুলিশ সদস্যদের টার্গেট করে হত্যা করতে অর্থ লেনদেন হয়েছে। তবে এখন রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’

২২ জুলাই পর্যন্ত শত শত বিক্ষোভকারীকে হত্যার পাশাপাশি হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কারফিউ ঘোষণা করে নাগরিকের স্বাধীনতা দমন করা হয় এবং ইন্টারনেট বন্ধের মাধ্যমে দেশকে কার্যত অচল করে দেওয়া হয়। সরকারি বাহিনীর বেপরোয়া গ্রেপ্তার, নির্বিচার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গ্রেপ্তার, মামলা ও গুমের মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হয়।

দেশের বিভিন্ন জেলায় র‍্যাব, পুলিশ, বিজিবি, সেনা ও আনসার বাহিনীসহ সরকারের ভয়াবহ নিপীড়নে হাজার হাজার মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, কুমিল্লাসহ প্রায় সব জেলায় মামলা ও গ্রেপ্তার চলে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ ও স্থানীয় নেতাকর্মীরাও গুম ও গ্রেপ্তারের শিকার হন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম সরকারি বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। তাকে অপহরণ করে লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়। পরে তাকে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় ডিবির সদস্যরা।

জনগণের মৌলিক অধিকার ও তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতা উলঙ্গভাবে উপেক্ষা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেন্সরশিপ আরোপ করে শেখ হাসিনা সরকার গণতন্ত্রকে হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত