আমার দেশ

শাহবাগ ও রাজশাহীতে অবরোধ

আবু সুফিয়ান
শাহবাগ ও রাজশাহীতে অবরোধ
ফাইল ছবি

সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত বছরের ১৩ জুলাই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন শিক্ষার্থীরা।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শেষে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। এতে শাহবাগ মোড় ও আশপাশের এলাকায় যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। একই দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এতে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।

বিজ্ঞাপন

২০২৪ সালের ১৩ জুলাই সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলনে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীদের নেতারা। তারা জানান, ১৪ জুলাই বেলা ১১টায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে একত্র হয়ে পদযাত্রা শুরু করবেন। একই সময় দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি জমা দেবেন। স্মারকলিপিতে সব গ্রেডে ৫ শতাংশ কোটা রেখে বাকি কোটা বাতিলের দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হবে বলে জানান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, মামলা দিয়ে তাদের আন্দোলনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তারা বলেন, আন্দোলন দমন করতে প্রশাসনের একাংশ ভয়ভীতি, নজরদারি ও হয়রানিমূলক কৌশল গ্রহণ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে ৫ শতাংশ কোটাকে আমরা যৌক্তিক মনে করি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত রাখার প্রস্তাব দিয়েছি। তবে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের কোটা অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক।’

আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘সরকার শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে শুরু থেকেই আলোচনা না করে দমন-পীড়নের কৌশল নিয়েছে। শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতপরিচয়ের আসামি করে মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি—এই মিথ্যা মামলা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে এবং হামলায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সরকার আদালতের আড়ালে থেকে এই সংকট দীর্ঘায়িত করছে। আমরা চাই জরুরি অধিবেশন ডেকে সংসদে বিষয়টি সমাধান করা হোক।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন এবং ছাত্র ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।

শিক্ষার্থীরা আরো বলেন, আন্দোলন দমনের যে কোনো অপচেষ্টা প্রতিহত করে তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকবেন। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা না দেওয়ার আহ্বান জানান।

সেদিন শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন শহরে সমর্থন বাড়তে থাকে এবং প্রতিদিনই নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এতে যোগ দিতে থাকনে।

এদিকে, ২০২৪ সালের ১১ জুলাই কুমিল্লায় আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিবর্ষণ ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা সরেজমিন দেখতে পরদিন সেখানে যান আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রতিনিধি দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের নেতারা। তারা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন।

আন্দোলনের আরেক নেতা সারজিস আলম বলেছিলেন, ‘১ জুলাই থেকে আন্দোলন চলছে কিন্তু এখনো সরকার কিংবা রাষ্ট্রের শীর্ষ মহল থেকে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি। যদি সরকার এ আন্দোলনকে উসকে দেয় কিংবা দমন-পীড়নের পথে হাঁটে, তাহলে এর দায়ভার তাদেরই নিতে হবে।’

সরকারি প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের (বর্তমানে পলাতক) বলেছিলেন, ‘আপিল বিভাগের রায় আসার আগে কোটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না। তবে কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আবেগকে পুঁজি করে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে।’

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও (বর্তমানে পলাতক) আন্দোলন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমার মনে হয়, শিক্ষার্থীদের কিছু সময় অপেক্ষা করা উচিত।’

অন্যদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, তাদের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ এবং গঠনমূলক। তারা বলেন, ‘মৌলিক অধিকারের পক্ষে কথা বলা যদি ষড়যন্ত্র হয়, তবে সেটা গণতন্ত্রের জন্যই ভয়ংকর।’

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা আরো জানান, অন্যান্য ছাত্র সংগঠন যদি যৌক্তিক আন্দোলনে পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যাখ্যান করবে।

তথ্য প্রতিমন্ত্রীর উসকানিমূলক বক্তব্য

কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছিলেন তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। বর্তমানে তিনি পলাতক। ওই সময় তিনি আন্দোলন প্রতিহত করতে দলীয় নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘কিছু ব্যক্তি শিক্ষার্থীদের আবেগকে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। কোটাসংক্রান্ত বিষয়টি বর্তমানে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকায় সরকারের পক্ষে এখন কিছু করা সম্ভব নয়।’

২০২৪ সালের ১৩ জুলাই রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘সরকার এবং আন্দোলনকারীদের মূল দাবি এক জায়গায়—২০১৮ সালের সরকারি পরিপত্র পুনর্বহাল। সরকার ওই পরিপত্র পুনর্বহালের জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এখন যারা আন্দোলনের নামে জনদুর্ভোগ তৈরি করছেন এবং দাবি বারবার পরিবর্তন করছেন, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে।’

আরাফাত মন্তব্য করেছিলেন, ‘আন্দোলনকারীরা কখনো কমিশন গঠনের দাবি করছেন, কখনো আইন করে কোটা সংস্কার চাচ্ছেন; যা একদিকে অসাংবিধানিক, অন্যদিকে নির্বাহী বিভাগের পক্ষে তা এখনই করা সম্ভব নয়।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আন্দোলনকারীদের দাবি কেন এত দ্রুত ও বারবার পরিবর্তন হচ্ছে?’

আন্দোলনে ব্যবহৃত ‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা’ স্লোগানের সমালোচনাও করেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিজেও মেধার পক্ষে। তবে তিনটি ধাপে (প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক) উত্তীর্ণ হওয়ার পর যারা কোটা সুবিধা পান, তাদের মেধাহীন বলা ঠিক নয়। ৩৫তম থেকে ৩৮তম বিসিএস পর্যন্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মাত্র ২ দশমিক ২৭ শতাংশ চাকরিপ্রার্থী এ ধাপগুলো অতিক্রম করতে পারেন।’

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন