সৈয়দ আবদাল আহমদ
ঢাকার বুকে ঘুমিয়ে আছেন নজরুল। কবি নজরুল গেয়েছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।’ তাঁর কবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই। কবরের সামনের বেদিতে উৎকীর্ণ রয়েছে নজরুলের সেই বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার লাইন
‘মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত...।’
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেছিলেন নজরুল। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রথম বিদ্রোহী প্রকাশিত হয়। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা মোসলেম ভারতেও একইসঙ্গে বিদ্রোহী ছাপা হয়।
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং এ সময় থেকেই তিনি পুরোপুরি সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর সাংবাদিকতা জীবনও তখনই শুরু হয়। ভারতে এ সময় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন চলছিল। নজরুল এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময়েই তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হয়Ñ
‘বল বীর-বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমার, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির।’
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী কবিতাকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। শতবর্ষী এ কবিতায় এত বিপুল বৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটেছে, যাকে সাহিত্যবিশ্লেষকরা এক কথায় বলেন অনন্য। কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলেছিল। কবিতাটিতে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশিত হয়েছে বলেই নজরুল বিদ্রোহী কবি নামে তখন থেকেই পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে সবার মাঝে নজরুল পরিচিত হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হয়েছে এই সেদিন। ২ জানুয়ারি ২০২৫ কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে আসার তারিখ থেকে তাকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে প্রজ্ঞাপনের গেজেট প্রকাশ করা হয়।
নজরুলের প্রিয় শহর ঢাকা
যে ঢাকায় নজরুল আছেন চিরনিদ্রায়, সেই ঢাকায় ছড়িয়ে আছে নজরুলের অসংখ্য স্মৃতি। কলকাতায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিক জীবন কাটালেও ঢাকা ছিল নজরুলের এক অতিপ্রিয় শহর। সুযোগ পেলেই তিনি চলে আসতেন ঢাকায়। ঢাকায় তার বন্ধুবান্ধবও কম ছিলেন না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কবি আবদুল কাদির, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ফজিলাতুন্নেসা, প্রফেসর সত্যেন বোস, হবিবুল্লাহ বাহার তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নজরুল গান গেয়েছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং বক্তৃতা দিয়েছেন। অনেক জনপ্রিয় কবিতা তিনি ঢাকায় বসে লিখেছেন। ঢাকার রমনা লেক ছিল নজরুলের একটি প্রিয় জায়গা। লেকের ধারে সাপের আস্তানা জেনেও শান্ত, নিরিবিলি ও মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানটিতে একান্ত সান্নিধ্যে যেতেন নজরুল। একদিন সন্ধ্যায় কবি আবদুল কাদিরকে সঙ্গে নিয়ে রমনা লেকে বেড়াতে গিয়ে তিনি লেখেনÑ‘নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরান পিয়াস’ গজলটি। নজরুল গেছেন আহসান মঞ্জিল ও পুরান ঢাকার রূপলাল হাউসের আসরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজের অনুষ্ঠানে। বুড়িগঙ্গা তীরের করোনেশন পার্কে ঘুরে বেড়িয়েছেন নজরুল। কবি তখন প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় বনগ্রামে যেতেন এবং রানু সোমকে গান শেখাতেন। তাঁর সংকল্প ছিল রানুকে গান শিখিয়ে গানের রেকর্ড বের করাবেন। রানু সোমের খাতায় ‘বসন্ত মুখর আজি’, ‘এলো বরষা শ্যাম সরসা প্রিয় দরশা’ প্রভৃতি গান লিখে দিয়েছেন। আবার বনগাঁ লেনে উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের আক্রমণের শিকার হলে তাদের পাল্টা আক্রমণও করেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর শিক্ষিত নারী বেগম ফজিলাতুন্নেসার হাতের রেখাও গণনা করে দিয়েছেন নজরুল। বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) তিনি থেকেছেন দিনের পর দিন। ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নজরুলকে পীড়িত করেছে। দাঙ্গা নিয়ে অসাধারণ একটি কবিতাও লিখেছেন তিনি। ‘দাঙ্গা’ কবিতার সঠিক রচনাকাল জানা না থাকলেও এটি যে বিশের দশকের হবে, সেটা বলা যায়। দাঙ্গা কবিতার কয়েকটি লাইন
‘এল কুৎসিত ঢাকার দাঙ্গা আবার নাঙ্গা হয়ে।
এল হিংসার চিল ও শকুন নখর চঞ্চু লয়ে।
সারা পৃথিবীর শ্মশানের ভূত-প্রেতেরা সর্বনেশে
ঢাকার বক্ষে আখা জ্বালাইতে জুটেছে কি আজ এসে?
এরা কি মানুষ? এরা আল্লার সৃষ্টি কি? হুঁশ নাই;
ডান হাত দিয়ে বাম হাত কাটে, ভাইকে মারিছে ভাই।’
অসুস্থ হওয়ার আগে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত নজরুল অন্তত বারো বার ঢাকা সফর করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে নজরুল চলে আসেন চিরদিনের জন্য ঢাকায়। তার শেষ জীবন ঢাকাতেই কাটে। ঢাকাই এখন নজরুলের চিরকালের ঠিকানা, শেষ ঠিকানা।
নজরুল প্রথম কখন ঢাকায় এসেছিলেন? কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসুর তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় কবির প্রথম আগমন ঘটে ১৯২৫ সালের ৪ জুলাই, শনিবার অথবা এর পরদিন। ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ফুটবলে দেশীয় দলের বিজয়ে আনন্দে উদ্বেল কবি বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঢাকার পথে। এর চেয়ে বেশি বিবরণ আর পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার কবি ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে। ওই সময় তিনি আতিথ্য নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার কাচার সংলগ্ন মোহিনী মোহন দাশের বাড়িতে। কবিকে সে সময় সারাক্ষণ সঙ্গ দিয়েছেন কবি আবদুল কাদির, আবুল কাশেম ও আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন। কবি তখন এক বা দু’দিন ঢাকায় ছিলেন।
১৯২৬ সালের জুন মাসে নজরুল ঢাকায় এসে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে মুসলিম সাহিত্য সমাজের চতুর্থ বৈঠকে যোগ দেন। সেবার তিনি ছাত্রদলের গান, কৃষাণের গান ও কান্ডারি হুঁশিয়ার ছাত্রদের গেয়ে শোনান। এ সময় নারায়ণগঞ্জের মোহাম্মদ কাশেম পত্রিকা বের করতে চাইলে কবি তাকে আশীর্বাণী লিখে দেন। পত্রিকার নাম ঠিক করে দেন অভিযান। লিখে দেন ‘আশীর্বাণী অভিযান’ নামের কবিতা
‘নতুন পথের যাত্রা-পথিক
চালাও অভিযান।’
কবি নজরুল ঢাকা বিভাগের মুসলমান কেন্দ্র থেকে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদপ্রার্থী হন। এ নির্বাচনের জন্য তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল ও অন্যান্য কাজের জন্য ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের অক্টোবরে। তিনি সেবার উঠেছিলেন আবুল হাসানাৎ ওরফে শাহজাদা মিয়ার বাড়িতে। নির্বাচন পরিচালনার কাজে ৩১ অক্টোবরও তিনি ঢাকায় আসেন পঞ্চমবারের মতো। সেবারও শাহজাদা মিয়ার বাড়িতেই ওঠেন। এক সন্ধ্যায় তিনি যান জয়দেবপুরে। সঙ্গে ছিলেন কবি আবদুল কাদির। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। অভিভূত কবি ট্রেনে বসেই লেখেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘চাঁদনী রাতে’
‘কোদাল মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনার রঙে।’
এখানে অবস্থানকালেই সুফিসাধক ইউসুফ আল কাদরী কাশ্মীরী শাহের মাজার সংলগ্ন বাগানে বসেই কবি লেখেন বাংলা গানের বাঁক পরিবর্তনকারী গজল ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’।
কবি নজরুলের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন তার স্মৃতিকথায় ১৯২৭ সালে কবির ঢাকা আগমনের বিবরণ লেখেন। সেবার ২৮ ফেব্রুয়ারি নজরুল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন বিশিষ্ট সম্মানীয় অতিথি হিসেবে নজরুল ওই অনুষ্ঠানে আসেন। তিনি উদ্বোধনী সংগীত ও কবিতা আবৃত্তি করেন এবং মুসলিম সাহিত্য সমাজের তরুণ সদস্যদের উদ্দেশে উৎসাহমূলক বক্তব্য দেন। গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে ‘খোশ আমদেদ’ (স্বাগতম) নামে উদ্বোধনী সংগীতটি তিনি রচনা করেন। করতালির মধ্যে নতুন লেখা এ গানটি তিনি এভাবে শুরু করেনÑ
‘আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালী!
ও চরণ ছুঁই কেমনে দুই হাতে মোর মাখা যে কালি!!’
ঢাকায় এসে তিনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি কক্ষের নিচের তলায় পূর্বদিকের অর্ধাংশে আস্তানা গাড়েন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে ওই গৃহের বাসিন্দা ছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বড় ডাইনিং হলে সাহিত্য সমাজের প্রথম অধিবেশন বসে। সে যাত্রায় ঢাকায় তিনি তিনদিন ছিলেন। ওই সময় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার কবিকে জগন্নাথ হলে আমন্ত্রণ জানান। কবি সেখানে তার বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন। এর একটি হলোÑ‘কে বিদেশী বন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে?’
ড. মোতাহার হোসেন আরো লেখেন : ১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মিলনীতে কবিকে আবার ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই সম্মেলনে তিনি তার উদ্দীপনামূলক সংগীত ও বক্তৃতা দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। এ সময় তিনি তার বিখ্যাত মার্চ সংগীতটি গেয়েছিলেন। কবি আবদুল কাদির লেখেন : এ সময় কবি নজরুল সাহিত্য সমাজের সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং ‘চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল...’ শীর্ষক মার্চ সংগীত রচনা করেন। ওইবারই অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, কবি বুদ্ধদেব বসু, কবি অজিত দত্ত এবং গণিত বিভাগের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। একই বছরের জুন মাসে পুনরায় নজরুল ঢাকায় এলে রানু সোম ও উমা মৈত্রের (লোটন) সঙ্গে তার পরিচয় ও সংগীতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন : সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় সম্মেলনে যোগদানের পর কবি বুড়িগঙ্গাতীরের জমিদার রূপলাল বাবুর বিশাল অট্টালিকা রূপলাল হাউসে যান এবং সেখানে গান গাইলেনÑ‘বসিয়া নদীকূলে এলোচুলে কে গো উদাসিনী’। ঢাকায় আসার পথে পদ্মা নদীতে স্টিমারে বসে গজলটি রচনা করেছিলেন কবি। একইভাবে তিনি গাইলেন : ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত।’ ঢাকায় এসে তিনি বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) নিচের তলায় আমার সঙ্গে থাকতেন। এ সময় বেশ কয়েকটি নিমন্ত্রণে কবির সঙ্গে আমি ছিলাম। নজরুল ঢাকায় যতদিন বর্ধমান হাউসে ছিলেন তিনি নিয়মিত প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে মনোরম সংগীত চর্চায় নিমগ্ন থাকতেন। এ সময় তিনি বেশ কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে গান শেখাতেন। এ প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেন লেখেন : একদিন বর্ধমান হাউসে আমাদের অতিথি কবি নজরুলের জন্য আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। এর আধ ঘণ্টা পর নজরুল এলেন। তার হাতে একটি লাঠি, গায়ের কুর্তায় রক্তের দাগ এবং শরীরে লাঠির আঘাতের চিহ্ন। তিনি জানালেন, ৭-৮ জনের যুবকের দল ছড়ি ও লাঠি দিয়ে নবাবপুর স্ট্রিটের কাছে বনগ্রাম লেনে তার ওপর আক্রমণ চালালে তিনিও লাঠি কেড়ে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে যুবকরা পালায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন একমাত্র মুসলিম উচ্চশিক্ষিত নারী গণিতের বেগম ফজিলাতুন্নেসা। ‘কবি নজরুল হাত দেখতে জানেন’Ñএ কথা মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে জানতে পেয়ে তিনি নজরুলের কাছে হাত দেখাতে আগ্রহী হন। মোতাহার হোসেন যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে ফজিলাতুন্নেসার বাসায় যান। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে নজরুল ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্ক রেখা, জীবনরেখা, হৃদয় রেখাসহ শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থান নিরীক্ষা করলেন। ঘণ্টাখানেক পর মোতাহার হোসেন কবিকে নিয়ে ফিরে এলেন বর্ধমান হাউসে। ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন কবি নজরুল নেই। সকালে নাশতার সময় ফিরে এলেন। এরপর তিনি ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়ার গল্প বললেন। নজরুল প্রেমে পড়লেও ফজিলাতুন্নেসা এদিকে আগাননি। কুমারী ফজিলাতুন্নেসা বিলাত যাওয়ার সময় তাই নজরুল কবিতা লিখেছিলেন ‘বর্ষা বিদায়’
‘ওগো বাদলের পরী! যাবে কোন দূরে ঘাটে বাঁধা
তব কেতকী পাতার তরী!’
দশমবারের মতো ঢাকায় কবির আগমন ঘটে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ সালে। কবির সফরসঙ্গী ছিলেন ধীরেন দাশ, নলিনীকান্ত সরকার এবং আব্বাস উদ্দীন আহমদের মতো বরেণ্য শিল্পী। একাদশ সফরে কবি ঢাকায় পা রাখেন ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে। বনগ্রাম লেনের সুনীল রায়ের বাড়ি ছিল সেবারের আস্তানা। কবি তার দ্বাদশতম ঢাকা সফরে আসেন ১৯৪০ সালের ১২ ডিসেম্বর। সুস্থ অবস্থায় এটাই কবির শেষ ঢাকা সফর। ঢাকা বেতারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘পূর্বাণী’ নামে গীতিবহুল অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্যই সেবার তার ঢাকায় আসা।
ঢাকা বেতার কেন্দ্র তখন ছিল আজকের শেখ বোরহানউদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে। সেদিনের সেসব স্থাপনা আজ আর নেই। থাকলে জানা যেত কবি কোথায় কোন কক্ষে বসে লিখেছিলেন : ‘আমি পূরব দেশের পুরনারী’।
এই সফরেও কবি সলিমুল্লাহ ও ফজলুল হক হলে ছাত্রদের দেওয়া সংবর্ধনায় অংশ নেন।
এদেশের জাতীয় ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল। এই আহসান মঞ্জিলে ঢাকার নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে একবার কবিকে দেওয়া হয়েছিল বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা। আর এই আহসান মঞ্জিলের মেয়ে এদেশের প্রথম মহিলা চিত্রশিল্পী মেহের বানুর আঁকা ছবি দেখে কবি লেখেন তার অসাধারণ কবিতা, ‘খেয়াপারের তরণী’ :
যাত্রীরা রাত্তিতে হতে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জেছে কে আবার?
চিরদিনের মতো অর্থাৎ ত্রয়োদশ সফরে কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় ১৯৭২ সালে। বাক্ ও লেখনী শক্তিহারা কবিকে তার ৭৩তম জন্মদিনের আগের দিন ২৪ মে, বুধবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমানে নিয়ে আসা হয় তেজগাঁ বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে কবিকে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ২৮ নম্বর সড়কে, ৩৩০ বি’র খোলামেলা সবুজ লনে ঘেরা একটি দোতলা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন জন্মদিনে কবিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হাজার হাজার মানুষ আসেন সে বাড়িতে। ঢাকায় কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয়। কবি ভবনে জাতীয় পতাকা উড়ানো হতো প্রতিদিন। এ বাড়িতে কবির ৩ বছর ১ মাস ২৮ দিন কাটে। পরবর্তীকালে এ কবি ভবনেই প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট প্রদান করে।
১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবিকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মান জানান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার। ওই বছরই জেনারেল জিয়াউর রহমানের আগ্রহে একুশে পদক চালু করা হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি কবি নজরুলকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ২৫ মে কবিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘আর্মি ক্রেস্ট’ উপহার দেওয়া হয়।
পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনেই কাটে কবি জীবনের শেষ দিনগুলো এক বছর এক মাস এক সপ্তাহ। এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রোববার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে পুরো জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাদের জাতীয় কবি।
ঢাকার বুকে ঘুমিয়ে আছেন নজরুল। কবি নজরুল গেয়েছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।’ তাঁর কবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই। কবরের সামনের বেদিতে উৎকীর্ণ রয়েছে নজরুলের সেই বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার লাইন
‘মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত...।’
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেছিলেন নজরুল। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রথম বিদ্রোহী প্রকাশিত হয়। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা মোসলেম ভারতেও একইসঙ্গে বিদ্রোহী ছাপা হয়।
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং এ সময় থেকেই তিনি পুরোপুরি সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর সাংবাদিকতা জীবনও তখনই শুরু হয়। ভারতে এ সময় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন চলছিল। নজরুল এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময়েই তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হয়Ñ
‘বল বীর-বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমার, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির।’
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী কবিতাকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। শতবর্ষী এ কবিতায় এত বিপুল বৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটেছে, যাকে সাহিত্যবিশ্লেষকরা এক কথায় বলেন অনন্য। কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলেছিল। কবিতাটিতে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশিত হয়েছে বলেই নজরুল বিদ্রোহী কবি নামে তখন থেকেই পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে সবার মাঝে নজরুল পরিচিত হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হয়েছে এই সেদিন। ২ জানুয়ারি ২০২৫ কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে আসার তারিখ থেকে তাকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে প্রজ্ঞাপনের গেজেট প্রকাশ করা হয়।
নজরুলের প্রিয় শহর ঢাকা
যে ঢাকায় নজরুল আছেন চিরনিদ্রায়, সেই ঢাকায় ছড়িয়ে আছে নজরুলের অসংখ্য স্মৃতি। কলকাতায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিক জীবন কাটালেও ঢাকা ছিল নজরুলের এক অতিপ্রিয় শহর। সুযোগ পেলেই তিনি চলে আসতেন ঢাকায়। ঢাকায় তার বন্ধুবান্ধবও কম ছিলেন না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কবি আবদুল কাদির, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ফজিলাতুন্নেসা, প্রফেসর সত্যেন বোস, হবিবুল্লাহ বাহার তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নজরুল গান গেয়েছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং বক্তৃতা দিয়েছেন। অনেক জনপ্রিয় কবিতা তিনি ঢাকায় বসে লিখেছেন। ঢাকার রমনা লেক ছিল নজরুলের একটি প্রিয় জায়গা। লেকের ধারে সাপের আস্তানা জেনেও শান্ত, নিরিবিলি ও মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানটিতে একান্ত সান্নিধ্যে যেতেন নজরুল। একদিন সন্ধ্যায় কবি আবদুল কাদিরকে সঙ্গে নিয়ে রমনা লেকে বেড়াতে গিয়ে তিনি লেখেনÑ‘নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরান পিয়াস’ গজলটি। নজরুল গেছেন আহসান মঞ্জিল ও পুরান ঢাকার রূপলাল হাউসের আসরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজের অনুষ্ঠানে। বুড়িগঙ্গা তীরের করোনেশন পার্কে ঘুরে বেড়িয়েছেন নজরুল। কবি তখন প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় বনগ্রামে যেতেন এবং রানু সোমকে গান শেখাতেন। তাঁর সংকল্প ছিল রানুকে গান শিখিয়ে গানের রেকর্ড বের করাবেন। রানু সোমের খাতায় ‘বসন্ত মুখর আজি’, ‘এলো বরষা শ্যাম সরসা প্রিয় দরশা’ প্রভৃতি গান লিখে দিয়েছেন। আবার বনগাঁ লেনে উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের আক্রমণের শিকার হলে তাদের পাল্টা আক্রমণও করেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর শিক্ষিত নারী বেগম ফজিলাতুন্নেসার হাতের রেখাও গণনা করে দিয়েছেন নজরুল। বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) তিনি থেকেছেন দিনের পর দিন। ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নজরুলকে পীড়িত করেছে। দাঙ্গা নিয়ে অসাধারণ একটি কবিতাও লিখেছেন তিনি। ‘দাঙ্গা’ কবিতার সঠিক রচনাকাল জানা না থাকলেও এটি যে বিশের দশকের হবে, সেটা বলা যায়। দাঙ্গা কবিতার কয়েকটি লাইন
‘এল কুৎসিত ঢাকার দাঙ্গা আবার নাঙ্গা হয়ে।
এল হিংসার চিল ও শকুন নখর চঞ্চু লয়ে।
সারা পৃথিবীর শ্মশানের ভূত-প্রেতেরা সর্বনেশে
ঢাকার বক্ষে আখা জ্বালাইতে জুটেছে কি আজ এসে?
এরা কি মানুষ? এরা আল্লার সৃষ্টি কি? হুঁশ নাই;
ডান হাত দিয়ে বাম হাত কাটে, ভাইকে মারিছে ভাই।’
অসুস্থ হওয়ার আগে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত নজরুল অন্তত বারো বার ঢাকা সফর করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে নজরুল চলে আসেন চিরদিনের জন্য ঢাকায়। তার শেষ জীবন ঢাকাতেই কাটে। ঢাকাই এখন নজরুলের চিরকালের ঠিকানা, শেষ ঠিকানা।
নজরুল প্রথম কখন ঢাকায় এসেছিলেন? কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসুর তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় কবির প্রথম আগমন ঘটে ১৯২৫ সালের ৪ জুলাই, শনিবার অথবা এর পরদিন। ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ফুটবলে দেশীয় দলের বিজয়ে আনন্দে উদ্বেল কবি বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঢাকার পথে। এর চেয়ে বেশি বিবরণ আর পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার কবি ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে। ওই সময় তিনি আতিথ্য নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার কাচার সংলগ্ন মোহিনী মোহন দাশের বাড়িতে। কবিকে সে সময় সারাক্ষণ সঙ্গ দিয়েছেন কবি আবদুল কাদির, আবুল কাশেম ও আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন। কবি তখন এক বা দু’দিন ঢাকায় ছিলেন।
১৯২৬ সালের জুন মাসে নজরুল ঢাকায় এসে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে মুসলিম সাহিত্য সমাজের চতুর্থ বৈঠকে যোগ দেন। সেবার তিনি ছাত্রদলের গান, কৃষাণের গান ও কান্ডারি হুঁশিয়ার ছাত্রদের গেয়ে শোনান। এ সময় নারায়ণগঞ্জের মোহাম্মদ কাশেম পত্রিকা বের করতে চাইলে কবি তাকে আশীর্বাণী লিখে দেন। পত্রিকার নাম ঠিক করে দেন অভিযান। লিখে দেন ‘আশীর্বাণী অভিযান’ নামের কবিতা
‘নতুন পথের যাত্রা-পথিক
চালাও অভিযান।’
কবি নজরুল ঢাকা বিভাগের মুসলমান কেন্দ্র থেকে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদপ্রার্থী হন। এ নির্বাচনের জন্য তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল ও অন্যান্য কাজের জন্য ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের অক্টোবরে। তিনি সেবার উঠেছিলেন আবুল হাসানাৎ ওরফে শাহজাদা মিয়ার বাড়িতে। নির্বাচন পরিচালনার কাজে ৩১ অক্টোবরও তিনি ঢাকায় আসেন পঞ্চমবারের মতো। সেবারও শাহজাদা মিয়ার বাড়িতেই ওঠেন। এক সন্ধ্যায় তিনি যান জয়দেবপুরে। সঙ্গে ছিলেন কবি আবদুল কাদির। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। অভিভূত কবি ট্রেনে বসেই লেখেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘চাঁদনী রাতে’
‘কোদাল মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনার রঙে।’
এখানে অবস্থানকালেই সুফিসাধক ইউসুফ আল কাদরী কাশ্মীরী শাহের মাজার সংলগ্ন বাগানে বসেই কবি লেখেন বাংলা গানের বাঁক পরিবর্তনকারী গজল ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’।
কবি নজরুলের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন তার স্মৃতিকথায় ১৯২৭ সালে কবির ঢাকা আগমনের বিবরণ লেখেন। সেবার ২৮ ফেব্রুয়ারি নজরুল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন বিশিষ্ট সম্মানীয় অতিথি হিসেবে নজরুল ওই অনুষ্ঠানে আসেন। তিনি উদ্বোধনী সংগীত ও কবিতা আবৃত্তি করেন এবং মুসলিম সাহিত্য সমাজের তরুণ সদস্যদের উদ্দেশে উৎসাহমূলক বক্তব্য দেন। গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে ‘খোশ আমদেদ’ (স্বাগতম) নামে উদ্বোধনী সংগীতটি তিনি রচনা করেন। করতালির মধ্যে নতুন লেখা এ গানটি তিনি এভাবে শুরু করেনÑ
‘আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালী!
ও চরণ ছুঁই কেমনে দুই হাতে মোর মাখা যে কালি!!’
ঢাকায় এসে তিনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি কক্ষের নিচের তলায় পূর্বদিকের অর্ধাংশে আস্তানা গাড়েন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে ওই গৃহের বাসিন্দা ছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বড় ডাইনিং হলে সাহিত্য সমাজের প্রথম অধিবেশন বসে। সে যাত্রায় ঢাকায় তিনি তিনদিন ছিলেন। ওই সময় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার কবিকে জগন্নাথ হলে আমন্ত্রণ জানান। কবি সেখানে তার বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন। এর একটি হলোÑ‘কে বিদেশী বন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে?’
ড. মোতাহার হোসেন আরো লেখেন : ১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মিলনীতে কবিকে আবার ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই সম্মেলনে তিনি তার উদ্দীপনামূলক সংগীত ও বক্তৃতা দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। এ সময় তিনি তার বিখ্যাত মার্চ সংগীতটি গেয়েছিলেন। কবি আবদুল কাদির লেখেন : এ সময় কবি নজরুল সাহিত্য সমাজের সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং ‘চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল...’ শীর্ষক মার্চ সংগীত রচনা করেন। ওইবারই অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, কবি বুদ্ধদেব বসু, কবি অজিত দত্ত এবং গণিত বিভাগের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। একই বছরের জুন মাসে পুনরায় নজরুল ঢাকায় এলে রানু সোম ও উমা মৈত্রের (লোটন) সঙ্গে তার পরিচয় ও সংগীতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন : সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় সম্মেলনে যোগদানের পর কবি বুড়িগঙ্গাতীরের জমিদার রূপলাল বাবুর বিশাল অট্টালিকা রূপলাল হাউসে যান এবং সেখানে গান গাইলেনÑ‘বসিয়া নদীকূলে এলোচুলে কে গো উদাসিনী’। ঢাকায় আসার পথে পদ্মা নদীতে স্টিমারে বসে গজলটি রচনা করেছিলেন কবি। একইভাবে তিনি গাইলেন : ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত।’ ঢাকায় এসে তিনি বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) নিচের তলায় আমার সঙ্গে থাকতেন। এ সময় বেশ কয়েকটি নিমন্ত্রণে কবির সঙ্গে আমি ছিলাম। নজরুল ঢাকায় যতদিন বর্ধমান হাউসে ছিলেন তিনি নিয়মিত প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে মনোরম সংগীত চর্চায় নিমগ্ন থাকতেন। এ সময় তিনি বেশ কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে গান শেখাতেন। এ প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেন লেখেন : একদিন বর্ধমান হাউসে আমাদের অতিথি কবি নজরুলের জন্য আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। এর আধ ঘণ্টা পর নজরুল এলেন। তার হাতে একটি লাঠি, গায়ের কুর্তায় রক্তের দাগ এবং শরীরে লাঠির আঘাতের চিহ্ন। তিনি জানালেন, ৭-৮ জনের যুবকের দল ছড়ি ও লাঠি দিয়ে নবাবপুর স্ট্রিটের কাছে বনগ্রাম লেনে তার ওপর আক্রমণ চালালে তিনিও লাঠি কেড়ে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে যুবকরা পালায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন একমাত্র মুসলিম উচ্চশিক্ষিত নারী গণিতের বেগম ফজিলাতুন্নেসা। ‘কবি নজরুল হাত দেখতে জানেন’Ñএ কথা মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে জানতে পেয়ে তিনি নজরুলের কাছে হাত দেখাতে আগ্রহী হন। মোতাহার হোসেন যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে ফজিলাতুন্নেসার বাসায় যান। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে নজরুল ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্ক রেখা, জীবনরেখা, হৃদয় রেখাসহ শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থান নিরীক্ষা করলেন। ঘণ্টাখানেক পর মোতাহার হোসেন কবিকে নিয়ে ফিরে এলেন বর্ধমান হাউসে। ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন কবি নজরুল নেই। সকালে নাশতার সময় ফিরে এলেন। এরপর তিনি ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়ার গল্প বললেন। নজরুল প্রেমে পড়লেও ফজিলাতুন্নেসা এদিকে আগাননি। কুমারী ফজিলাতুন্নেসা বিলাত যাওয়ার সময় তাই নজরুল কবিতা লিখেছিলেন ‘বর্ষা বিদায়’
‘ওগো বাদলের পরী! যাবে কোন দূরে ঘাটে বাঁধা
তব কেতকী পাতার তরী!’
দশমবারের মতো ঢাকায় কবির আগমন ঘটে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ সালে। কবির সফরসঙ্গী ছিলেন ধীরেন দাশ, নলিনীকান্ত সরকার এবং আব্বাস উদ্দীন আহমদের মতো বরেণ্য শিল্পী। একাদশ সফরে কবি ঢাকায় পা রাখেন ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে। বনগ্রাম লেনের সুনীল রায়ের বাড়ি ছিল সেবারের আস্তানা। কবি তার দ্বাদশতম ঢাকা সফরে আসেন ১৯৪০ সালের ১২ ডিসেম্বর। সুস্থ অবস্থায় এটাই কবির শেষ ঢাকা সফর। ঢাকা বেতারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘পূর্বাণী’ নামে গীতিবহুল অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্যই সেবার তার ঢাকায় আসা।
ঢাকা বেতার কেন্দ্র তখন ছিল আজকের শেখ বোরহানউদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে। সেদিনের সেসব স্থাপনা আজ আর নেই। থাকলে জানা যেত কবি কোথায় কোন কক্ষে বসে লিখেছিলেন : ‘আমি পূরব দেশের পুরনারী’।
এই সফরেও কবি সলিমুল্লাহ ও ফজলুল হক হলে ছাত্রদের দেওয়া সংবর্ধনায় অংশ নেন।
এদেশের জাতীয় ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল। এই আহসান মঞ্জিলে ঢাকার নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে একবার কবিকে দেওয়া হয়েছিল বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা। আর এই আহসান মঞ্জিলের মেয়ে এদেশের প্রথম মহিলা চিত্রশিল্পী মেহের বানুর আঁকা ছবি দেখে কবি লেখেন তার অসাধারণ কবিতা, ‘খেয়াপারের তরণী’ :
যাত্রীরা রাত্তিতে হতে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জেছে কে আবার?
চিরদিনের মতো অর্থাৎ ত্রয়োদশ সফরে কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় ১৯৭২ সালে। বাক্ ও লেখনী শক্তিহারা কবিকে তার ৭৩তম জন্মদিনের আগের দিন ২৪ মে, বুধবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমানে নিয়ে আসা হয় তেজগাঁ বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে কবিকে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ২৮ নম্বর সড়কে, ৩৩০ বি’র খোলামেলা সবুজ লনে ঘেরা একটি দোতলা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন জন্মদিনে কবিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হাজার হাজার মানুষ আসেন সে বাড়িতে। ঢাকায় কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয়। কবি ভবনে জাতীয় পতাকা উড়ানো হতো প্রতিদিন। এ বাড়িতে কবির ৩ বছর ১ মাস ২৮ দিন কাটে। পরবর্তীকালে এ কবি ভবনেই প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট প্রদান করে।
১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবিকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মান জানান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার। ওই বছরই জেনারেল জিয়াউর রহমানের আগ্রহে একুশে পদক চালু করা হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি কবি নজরুলকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ২৫ মে কবিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘আর্মি ক্রেস্ট’ উপহার দেওয়া হয়।
পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনেই কাটে কবি জীবনের শেষ দিনগুলো এক বছর এক মাস এক সপ্তাহ। এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রোববার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে পুরো জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাদের জাতীয় কবি।
গাজা পুনরুদ্ধারের এই সময়ে ‘ফিলিস্তিন সাংস্কৃতিক পুরস্কার’ ঘোষণা করেছে ‘ফিলিস্তিন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট’। ১৩তম আসরের মূল থিম নির্ধারণ করা হয়েছে—‘জেরুজালেম, গাজা উপত্যকা, গোটা ফিলিস্তিন ও জায়নবাদের বিরোধিতা’।
৩ দিন আগেএকশ বছর আগের কথা। ১৮৮৯ সাল। তুরিনে আজকের মতোই এক দিনে ফ্রিডরিখ নিৎশে কার্লো আলবার্তো পথের ৬ নম্বর বাড়ির ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন। কখনো হাঁটতে বের হতেন, আবার কখনো পোস্ট অফিসে চিঠিপত্র তুলতে যেতেন।
৪ দিন আগেবাইতুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী আয়োজিত ইসলামি বইমেলায় প্রতিদিনই জড়ো হন হাজারো মানুষ। বিশেষত সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে বইপ্রেমীদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। আর এই জনস্রোতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একদল স্বপ্নবাজ তরুণের হাতে গড়া ‘লিটলম্যাগ কর্নার’।
৪ দিন আগেইসলাম-পূর্ব সময়ে এক ভয়ংকর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল যেন আরবরা। সমগ্র আরবে চলছিল ভয়াবহ অরাজকতা। গোত্রে গোত্রে শত্রুতা। সারাক্ষণ একে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টায় রত। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি ও মারামারি থেকে শুরু করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া; বছরের পর বছর ধরে সেই যুদ্ধ চলা।
৪ দিন আগে