রিটার্নের তথ্যের অতিরিক্ত সম্পদ শ্যামল দত্তের

কাওসার আলম
প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৫, ০৮: ৫৮
ফাইল ছবি

ঢাকা ক্লাবের সদস্য পদ ২০১২ সালের জুনে ৩ লাখ ৫ হাজার টাকায় ক্রয় করেন শ্যামল দত্ত। সদস্যপদ পাওয়ার পর ক্লাবে ব্যয় করেন ৩২ লাখ ৪৬ হাজার টাকারও বেশি। কিন্তু এর কোনো কিছুই উল্লেখ নেই তার আয়কর নথিতে।

শুধু তাই নয়, ৪টি গাড়ির মালিকানা থাকলেও নথিতে মাত্র একটির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। এছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্য গোপনসহ মাসিক বেতন অর্ধেকেরও কম দেখিয়েছেন। তার আয় ও সম্পদের উৎস সন্ধান এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। তা সত্ত্বেও যে হিসাব পাওয়া গেছে তাতেই তার বিরুদ্ধে বড় ধরনের কর ফাঁকির অভিযোগ মিলেছে।

বিজ্ঞাপন

শ্যামল দত্ত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ভোরের কাগজের (বর্তমানে প্রকাশনা বন্ধ) সম্পাদক। হত্যাসহ একাধিক মামলার এ আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের আয়কর নথিতে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে তার প্রকৃত আয় ও সম্পদের তথ্য যাচাই করে দেখছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন আয়কর গোয়েন্দা তদন্ত ইউনিট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত ইউনিটের মহাপরিচালক রকিবুর রহমান আমার দেশকে বলেন, শ্যামল দত্তের আয়কর রিটার্নের সঙ্গে তার প্রকৃত সম্পদের বিষয়ে তদন্ত চলমান। আমরা কিছু তদন্ত শেষ করেছি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শ্যামল দত্তের পাশাপাশি তার স্ত্রীর আয়কর নথির তথ্যও যাচাই করছে আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট। এদিকে শ্যামল দত্ত ছাড়াও হাসিনার শাসনামলের প্রভাবশালী আরো ৩৪ সাংবাদিকের আয়কর নথিও তদন্তাধীন। তাদের মধ্যে রয়েছেন— নাইমুল ইসলাম খান, মোজাম্মেল বাবু, সন্তোষ শর্মা, মঞ্জুরুল ইসলাম, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সুভাষ সিংহ রায়, মুন্নী সাহা প্রমুখ। এসব সাংবাদিকের অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। কেউ পলাতক কিংবা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার অবস্থায় রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা গেছে, শ্যামল দত্ত তার আয়কর নথিতে দেওয়া তথ্যের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি আয় করেছেন। ২০২২-২৩ করবর্ষে আয়কর রিটার্নে তিনি তার মোট আয় দেখিয়েছেন ২২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু বেতন বাবদ প্রতি মাসে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে ৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে শুধু বেতন বাবদ তার আয়ের পরিমাণ ছিল ৪৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া বছরে বোনাস নিয়েছেন প্রায় ৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ শুধু বেতন-বোনাস বাবদ বছরে তিনি ৫২ লাখ টাকা আয় করেছেন। এ ছাড়া শুধু একটি ব্রোকারেজ হাউসের তথ্যানুসারে একই করবর্ষে শেয়ারবাজারে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৭ লাখ টাকা। কিন্তু বিনিয়োগের এ তথ্য তার আয়কর নথিতে নেই।

ব্যক্তিগত গাড়ির তথ্যেও শ্যামল দত্ত অনিয়মের আশ্রয় ‍নিয়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এ পর্যন্ত তার নামে ৪টি গাড়ির মালিকানার তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনি তার আয়কর নথিতে মাত্র একটি গাড়ির মালিকানার তথ্য দিয়েছেন। আবার গাড়ির প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে অনেক কম মূল্য দেখানো হয়েছে। গাড়ির ক্রয়মূল্য এক কোটি টাকা হলেও আয়কর রিটার্নে তা ৩৫ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১-২২ করবর্ষে শ্যামল দত্ত বেতন ও বোনাস বাবদ পেয়েছেন প্রায় ৪৪ লাখ টাকা। ওই সময় তিনি প্রতি মাসে বেতন নিয়েছেন সাড়ে ৩ লাখ টাকা। আর বাকি অর্থ পেয়েছেন বোনাস হিসেবে। কিন্তু তিনি আয়কর রিটার্নে দেখিয়েছেন ১৭ লাখ টাকার মতো। একই সঙ্গে ওই সময়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কোনো তথ্যই উল্লেখ করেননি তিনি। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য গঠিত ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবলাইজেশন ফান্ডের পরিচালক হিসেবে ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৪ লাখ ১১ হাজার টাকা সম্মানী পেলেও সেটিও আয়কর নথিতে উল্লেখ না করে গোপন করেছেন তিনি।

শ্যামল দত্তের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। সেখানে তিনি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু সে বাড়ির তথ্যও নেই নথিতে। আয়কর গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাতকানিয়ার বাড়ি ছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে তার কোনো বাড়ি বা জমি রয়েছে কি না, সেটিও তদন্ত করে দেখা হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কাজে নিযুক্ত একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, শ্যামল দত্তের আয়কর রিটার্নের তথ্যের বিষয়ে তদন্ত এখনো চলমান। প্রাথমিক তদন্তে আমরা সম্পদের বেশকিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। এতে দেখা যায়, তার প্রকৃত আয় ও সম্পদের সঙ্গে দাখিলকৃত রিটার্নের সম্পদের অনেক অমিল রয়েছে। তবে আরো সম্পদ রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে আমাদের তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে।

আয়কর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আইন অনুযায়ী আয়করদাতার রিটার্নে আয়, ব্যয় ও সম্পদের বিবরণী দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখন যদি কেউ প্রকৃত তথ্য গোপন করে তাহলে তদন্তসাপেক্ষে প্রাপ্ত সম্পদ হিসাব করে জরিমানাসহ আয়কর ও সম্পদ অনুযায়ী সারচার্জ আদায়ের নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া আয়কর ফাঁকির জন্য মামলা করারও বিধান রয়েছে। তবে শ্যামল দত্তের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

কারাগারে থাকার কারণে শ্যামল দত্তের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, মক্কেল আমাদের কাছে তার আয়, ব্যয় ও সম্পদের যে বিবরণী দিয়ে থাকে তারই ভিত্তিতে আইনজীবী হিসেবে আমরা আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকি। কিন্তু করদাতা কোনো তথ্য গোপন করলে সে বিষয়ে আইনজীবীর কোনো ধারণা বা জ্ঞান থাকে না। সরবরাহকৃত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের পর যদি কোনো করদাতার অতিরিক্ত কোনো আয়, ব্যয় বা সম্পদের কোনো তথ্য পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে করদাতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। করদাতা সম্পদের অতিরিক্ত তথ্যের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আগের রিটার্নকে যথাযথ দাবি করতে পারেন কিংবা পুনরায় সংশোধিত আকারে রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। কিন্তু নোটিস দেওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো জবাব না দিলে করদাতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে এনবিআর।

এদিকে শ্যামল দত্ত ও তার স্ত্রী সঞ্চিতা কনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ)। গত বছরের ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান শ্যামল দত্ত। ভারতে পালানোর সময় গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ও পোড়াকান্দুলিয়া সীমান্তের মাঝামাঝি এলাকা থেকে তাকে আটক করে স্থানীয় জনতা। এ সময় তার সঙ্গে আটক হন একাত্তর টিভির মোজাম্মেল বাবু। বর্তমানে তিনি হত্যাসহ একাধিক মামলায় কারাগারে রয়েছেন।

আরো ৩৪ সাংবাদিকের তথ্য যাচাই চলছে

শ্যামল দত্তসহ ৩৫ সাংবাদিকের আয়কর তথ্য যাচাই করছে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। হাসিনার শাসনামলে এরা খুবই প্রভাবশালী ছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন- ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আবেদ খান, আবুল কালাম আজাদ, নঈম নিজাম, সুভাষ সিংহ রায়, জাফর ওয়াজেদ, স্বদেশ রায়, মাসুদা ভাট্টি, মুন্নী সাহা, রাহুল রাহা, সৈয়দ বোরহান কবীর, জ ই মামুন, নূরুল আমিন প্রভাষ, প্রণব সাহা, অশোক চৌধুরী, ফারহানা নিশো প্রমুখ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত