কফিন মিছিলের সেই কফিন সংগ্রহের ইতিহাস ভিন্নভাবে জানালেন তারা

ঢাবি সংবাদদাতা
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০২: ৩৩
আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০২: ৩৩
২০২৪ এর ১৭ জুলাই ভিসি চত্বরে সেই গায়েবানা জানাজা, ইনসেটে আব্দুল কাদের, জায়েদুল হক ও এস এম ফরহাদ

আজ ১৭ জুলাই, ঠিক এক বছর আগে এ দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের আয়োজন করা হয়। আগের দিন (১৬ জুলাই ২০২৪) ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে ৬ জন শহীদ হন। তাদেরই প্রতীকী গায়েবানা জানাজা ও পরে কফিন মিছিলের আয়োজন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিন চারদিকে হাসিনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তার আ.লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ছয়টি কফিন সংগ্রহ ও তা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করানো হয়েছিল, সেই ইতিহাস তুলে ধরেছেন আব্দুল কাদের, জায়েদুল হক ও এস এম ফরহাদ।

বিজ্ঞাপন

চব্বিশের ১৭ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের মাগফিরাত কামনায় এই দিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে গায়েবানা জানাজার নামাজ আদায় করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। পরে তারা কফিন মিছিল করেন। ১৬ জুলাই ৬ জন নিহতের ঘটনায় ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি দিলেও পুলিশের বাধার কারণে তা করতে পারেননি আন্দোলনকারীরা।

পরে তারা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গায়েবানা জানাজার নামাজ আদায় করেন। এরপর কফিন মিছিল বের করলে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সোয়াট সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এই কফিন মিছিলের কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা এবং কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ও পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে কফিন ব্যবস্থার সঙ্গে কারা সম্পৃক্ত ছিল তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলোচনার সূত্রপাত বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ঢাবি শাখার আহ্বায়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের দেওয়া আজকের (বৃহস্পতিবার) ফেসবুক পোস্ট থেকে। আব্দুল কাদের সেই কফিন মিছিলের স্মৃতিচারণ করে তার ফেসবুক পোস্টটিতে সেদিনের ঘটনা তুলে ধরেছেন। এতে তিনি দাবি করেছেন, কফিন ব্যবস্থা করার দায়িত্বে তারা ছিল। কিন্তু তার এ বর্ণনায় কিছুটা ভিন্নমত পোষণ ও তথ্যগত ভিন্নতা তুলে ধরেছেন ঢাবি শিবিরের তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক জায়েদুল হক এবং বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ।

তারা বলছেন, কফিন জামায়াতের মহানগরের ও শাহবাগ থানার দুই নেতার মাধ্যমে তাদের (শিবির) তত্ত্বাবধানে কফিনগুলো ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাছাড়া, এ বিষয়ে তারা আরও কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় তুলে ধরেছেন।

আব্দুল কাদের তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, গায়েবানা জানাজা এবং কফিন মিছিলের কফিন, কাফনের কাপড় ম্যানেজ করার দায়িত্ব ছিল আমার। সকাল থেকে ডামাডোলের মধ্যে সেগুলা কেনা আর সম্ভব হয় নাই। তখন শিবিরের তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক জায়েদের সাথে দেখা হলে তাকে বিষয়টা জানাই- কাউকে দিয়ে কফিন নিয়ে আসতে পারবে কি না। জায়েদ আমাকে আশ্বস্ত করে এবং এক ভাইয়ের নাম্বার দেয়, উনি পৌঁছে দিবে। ঘন্টা দুয়েক পরে ঐ ভাই ফোন দিল, “কোনোভাবেই কফিন ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকানো যাচ্ছে না। সবগুলা প্রবেশপথে পুলিশ মোতায়েন করা”। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, কেবল কাফনের কাপড় দিয়েই জানাজা পড়াব। উনার সাথে যোগাযোগ করে মুজিব হলের পকেট গেটে গেলাম, গেট বন্ধ। উনি ঐপাশ থেকে গেটের উপর দিয়ে কাপড়ের ব্যাগ ছুঁড়ে মারলেন। সেটা নিয়েই ভিসিতে চলে আসলাম। কিন্তু মনে মানতেছিল না, কফিন ছাড়া জানাজা এবং মিছিল অসম্পূর্ণ লাগে। উনি অবশ্য নানানভাবে চেষ্টা করেছিলেন, কফিনটা ঢুকানোর জন্য। অ্যাম্বুল্যান্সে করে বিভিন্ন প্রবেশমুখ দিয়ে ঢুকার চেষ্টা করেছেন।

আব্দুল কাদেরের পর ঢাবি শিবিরের তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন বিভাগের সদস্য জায়েদুল হক এক ফেসবুক পোস্টে ঘটনার বিবরণ জানিয়ে বলেন, ১৭ জুলাই, ২০২৪। সকালে সাদিক কায়েম ভাই আমাকে ফোন করেন। ভাই বললেন, ‘আজকের গায়েবানা জানাজার জন্য ৬টা কফিন ম্যানেজ করতে হবে। কফিন ম্যানেজ করার দায়িত্ব তোমার।’ কিছুক্ষণ পর নাহিদ ইসলাম ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, কফিনের সাথে বড় পতাকা আর কিছু ফুল নিয়ে আসতে।

এস এম ফরহাদ ভাই জানালেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ও জামায়াতের শাহবাগ পশ্চিমের আমির অ্যাডভোকেট শাহ মাহফুজুল হক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করো, উনি কফিন ম্যানেজ করে দিতে পারবেন।” ফোন করলাম মাহফুজ ভাইকে। তিনি বললেন, “দুইটা কফিন কাটাবন থেকে পাওয়া যাবে, আর বাকিগুলো দেলোয়ার ভাই পাঠাবেন।” দেলোয়ার ভাই ছিলেন তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি। মাহফুজ ভাই তার এবং পল্টনের শাহীন ভাইয়ের নম্বর দিলেন। শাহীন ভাই একটি লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে চারটি কফিন পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। মাহফুজ ভাইয়েরা কাঁটাবন থেকে দুটি কফিন নিয়ে নীলক্ষেতে ঢুকানোর চেষ্টা করলে পুলিশ ঢুকতে দেয় না। পল্টন থেকে পাঠানো কফিনবাহী ফ্রিজিং গাড়িটিও অনেক চেষ্টা করেও ঢুকতে পারে না।

জায়েদ লেখেন, এই সংকটময় মুহূর্তে শাহ মাহফুজ ভাই আবার ফোন করলেন, “তোমরা মুজিব হলের পকেট গেটে আসো। অন্তত সাদা কাপড়গুলো নিয়ে যাও। সেগুলো দিয়ে লাঠি বা ইটের উপর কফিন সাজিয়ে জানাজা সম্পন্ন করতে পারো।”

আমি ও আব্দুল কাদের ছুটে গেলাম। পকেট গেট ছিল বন্ধ। গেটের উপর দিয়ে সাদা কাপড়গুলো ভেতরে আনা হলো। তখন ভিসি চত্বরে শত শত শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে। মাহফুজ ভাই আবার ফোন দিলেন, “একটা মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত আসো। পুলিশ বাধা দিতে পারবে না। অন্তত একটা কফিন নিয়ে যাও।” এরপর আব্দুল কাদেরসহ আমরা একটা মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত থেকে ২টা কফিন নিয়ে আসি। এই সময়ে কফিনবাহী ফ্রিজিং গাড়িটিও মেডিকেল মোড় দিয়ে ঢুকতে পারে। গাড়িটিকে ভিসি চত্বরে চলে আসতে বলি। কিছুক্ষণের মধ্যে বাকি ৪টি কফিনও ভিসি চত্বরে এসে পৌঁছায় এবং গায়েবানা জানাজা শুরু হয়। গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিলে পুলিশ আক্রমণ করলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং অনেকে আহত হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এরই মাধ্যমে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা পতনের দিকে এগিয়ে যায়।

অন্যদিকে, ঢাবি শিবিরের বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ১৬ তারিখ সন্ধ্যায় ছয়জনের মৃত্যুর খবর আসার পর সাদিক কায়েমসহ আমরা বসে ১৭ তারিখের সম্ভাব্য কর্মসূচির ব্যাপারে পরামর্শ করি। আমাদের দিক থেকে কর্মসূচি হিসেবে চিন্তা করা হয় ‘গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল।’ আমাদের পরিকল্পনা ছিলো, অন্তত একজন শহীদের লাশ হলেও জানাজায় আনার চেষ্টা করা। শহীদ পরিবারের সাথে কথা বলে জানতে পারি, প্রশাসনের হুমকির মুখে তারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে অপারগ। এই প্রেক্ষিতে সিম্বলিক কিছু কফিন নিয়ে কফিন মিছিলের সিদ্ধান্ত হয়।

তিনি বলেন, সন্ধ্যায় মাহফুজ আলম কল দিয়ে পরদিনের কর্মসূচি ঘোষণার জন্য পরামর্শ করতে চাইলে কর্মসূচি হিসেবে ‘গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল’ এর কথা বলি। আমি এবং সাদিক কায়েম এই বিষয়ে মাহফুজ আলম ও নাহিদ ইসলামের সাথে কয়েক দফা কথা বলি। তারপর বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ওনারা নিজেদের ফোরামে আলোচনা করে এই আইডিয়া কর্মসূচি হিসেবে পালন করার জন্য অন্য সমন্বয়কদের মোটামুটি কনভিন্স করেন। এবং ঘোষণা দেন। নাহিদ ইসলাম আমাদের জায়েদকে ফোন দিয়ে জানায় যে, “জানাজার জন্য সাতটি কফিন লাগবে এবং কফিনগুলো ফুল বা পতাকা দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে।” মাহফুজ ভাইয়ের সাথে রাতে ও পরদিন সকালে কয়েকবার কফিন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়।

ফরহাদ আরও বলেন, আমাদেরকে কফিন ক্রয়ের ব্যাপারে সহযোগিতা করেন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলোয়ার ভাই এবং জামায়াতের শাহবাগ থানার আমির, ছাত্রশিবির ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি শাহ মাহফুজুল হক। ওনারা মোট ৬টি কফিন কিনেন। চারদিকে পুলিশ ও ছাত্রলীগের বাধার মুখেও আমাদের টিম কফিনগুলো ক্যাম্পাসের ভিতরে কয়েক ধাপে অ্যাম্বুলেন্সে বহন করে প্রবেশ করায়।

এদিকে কফিন আনার সময় ভুলবশত একই গাড়িতে পতাকা আনা হয়নি। পরে, তানভীর ভাই মুজিব হলের পকেট গেইটের ওয়ালের উপর দিয়ে সাদা কাপড় ও পতাকাগুলো আমাদের টিমের কাছে পৌঁছে দেয়। জানাজার নামাজের পর মিছিল রাজু ভাস্কর্যের দিকে গেলে আইএমএল-এর সামনে পুলিশ উপস্থিত আন্দোলনকারীদের উপর টিয়ারশেল ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছত্রভঙ্গ হয় সেদিনের মিছিল, আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত