দেশে প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ কোনো রাজনৈতিক দল আছে কিনা—তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, রাজনীতি এখন ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে; রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের মতো আচরণ করছে।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সম্মেলন কক্ষে ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকস (দায়রা) কর্তৃক আয়োজিত “বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থায়ন সংস্কৃতি ও ব্যবসা সুরক্ষা: বাস্তবতা ও সমাধানের পথ” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় বক্তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থায়ন কাঠামোর অন্তর্নিহিত অস্পষ্টতা, দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং অনানুষ্ঠানিক লেনদেনের ওপর নির্ভরশীলতার নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরেন। পাশাপাশি দলীয় অর্থায়নের অস্বচ্ছতা কিভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা, নীতিনির্ধারণ এবং ন্যায্য বাজারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে—তা নিয়ে মতামত দেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক–ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট বৈষম্য, দুর্বল জবাবদিহিতা এবং ব্যবসায়িক সুরক্ষার নামে গড়ে ওঠা অনিশ্চিত ও প্রতিযোগিতাহীন পরিবেশের কথাও আলোচনায় উঠে আসে।
আলোচনার শুরুতে দায়রার পক্ষ থেকে নীতি–সংক্ষেপ (পলিসি ব্রিফ) উপস্থাপন করেন গবেষক রাগীব আনজুম ও আহমুদুল হক। তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন সংস্কৃতি—বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক ব্যয়ের বাইরে দলগুলোর নিয়মিত আয়–ব্যয়ের কাঠামো, পদ্ধতি ও অস্বচ্ছতার চিত্র তুলে ধরেন। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণ ও এর প্রভাব ব্যাখ্যা করতে তারা তিনটি বিশ্লেষণধর্মী মডেল উপস্থাপন করেন। দলগুলোর অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তবসম্মত নীতি–প্রস্তাবও তারা তুলে ধরেন।
সমাধানের প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যদি সব জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে আয়–ব্যয়ের হিসাব জমা দেন এবং তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়, এবং যেকোনো ধরনের অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে দুদক ও নির্বাচন কমিশন জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে—তাহলেই সমাধান হয়ে যায়।”
একই বিষয়ে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন তুলি বলেন,“বাংলাদেশের আইনে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থ সংগ্রহ ও আয়ের বৈধ উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। এগুলো আইনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছাই চলমান সংকট সমাধানে প্রধান ভূমিকা রাখবে।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক আয়–ব্যয়ের বিষয়ে দলটির সহকারী মহাসচিব আহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, “রসিদ ও ভাউচার ছাড়া জামায়াতের কোনো আয়–ব্যয় নেই। আমাদের আয়ের উৎস জনশক্তি—প্রতিমাসে সদস্যরা তাদের আয়ের ৫ শতাংশ দলকে দিতে বাধ্য থাকেন।”
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, “স্বচ্ছতার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকেই কেন সবসময় কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়? আমলা, সচিবসহ যারা ক্ষমতা উপভোগ করেন—তাদের কেন প্রশ্ন করা হয় না?”
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, “গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে ব্যবসা ও রাজনীতির সম্পর্ক অনেক বেড়েছে। রাজনৈতিক যোগাযোগ ছাড়া ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল।”
খালেদ সাইফুল্লাহর সঙ্গে একমত হয়ে সাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, “নানা ধরনের ব্যবসায়িক স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ দিতে ব্যবসায়ীরা এক ধরনের বাধ্যবাধকতা অনুভব করেন।”
রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন সংস্কৃতির চলমান সংকট নিরসনে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবর রহমান।
এসআর

