শিশুদের অপুষ্টি সমস্যা এখনো প্রকট

এমরানা আহমেদ
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৫: ০৮

দেশে শিশুদের অপুষ্টি সমস্যা এখনো প্রকট। এ ছাড়া তীব্রতম অপুষ্টিতে (সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন বা এসএএম) ভুগছে অনেক শিশু। বিশেষ করে গত এক বছরে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির এ তীব্রতম মাত্রার প্রকোপ বেড়েছে অনেক বেশি। স্বাভাবিক শিশুদের থেকে তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুঝুঁকি ১২ গুণ বেশি। বর্তমানে মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে।

বিজ্ঞাপন

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) ২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। অপুষ্টিজনিত কারণে ২৩ দশমিক ৬ ভাগ শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং শতকরা ৩ ভাগ শিশু জন্মের পাঁচ বছরের আগেই মারা যায়। একই সঙ্গে বেড়েছে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যাও। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও ওয়েলথাঙ্গারহিলফ যৌথভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে মাঝারি মাত্রার ক্ষুধাপীড়িত দেশের তালিকায় রাখা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, তীব্র অপুষ্টি পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। সারা বিশ্বে প্রায় দুই কোটি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। আর ১০ লাখের মতো শিশুর মৃত্যু হয়। এসব শিশুর অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দা।

বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রতি চারজনে একজনেরও বেশি শিশু পুষ্টিকর খাবারের অভাবে রয়েছে। শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারের মারাত্মক ঘাটতি নিয়ে সতর্ক করছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। বিশ্বজুড়ে ১৮ কোটির বেশি শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে ঠিকমতো বেড়ে না ওঠার ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউনিসেফের সম্প্রতি ‘শৈশবকালীন খাদ্য সংকট: প্রারম্ভিক শৈশবে পুষ্টি বঞ্চনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ন্যূনতম যে পাঁচ ধরনের খাদ্য গ্রহণের সুপারিশ করেছে, প্রায় এক কোটি শিশু তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ইউনিসেফ বলছে, শৈশবকালীন পর্যাপ্ত সুষম খাবারের ঘাটতি সব শিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, তবে এর বিশেষ প্রভাব দেখা যায় শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে। উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন সুষম খাদ্যের তীব্র সংকটের মধ্যে বাস করে, যারা দিনে মাত্র দু-এক ধরনের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। যেসব শিশু নিয়মিত এই পাঁচ ধরনের খাবার খেতে পারে না তাদের শীর্ণকায় হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেশি থাকে।

ইউনিসেফের সুপারিশ অনুযায়ী, এমন শিশুদের দৈনিক আটটি উপাদানের খাবারের মধ্যে অন্তত পাঁচটি উপাদান খেতে হয়। এগুলো হলো মায়ের বুকের দুধ, শস্য, মূলজাতীয় খাবার, কন্দ ও কলা; ডাল, বাদাম ও বীজজাতীয় খাদ্য; মাংস, মুরগি ও মাছ; ডিম; ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার ও সবজি এবং অন্যান্য ফল ও সবজি।

ডব্লিউএইচওর নির্দেশনার ভিত্তিতে বর্তমানে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে স্যাম (এসএএম) কর্নার চালু হয়েছে। এসব কর্নারে এখন শিশুর অপুষ্টিজনিত সমস্যার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকরণ ও থেরাপিউটিক খাবার (এফ-৭৫ ও এফ-১০০) সরবরাহ করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ২০১২ সাল থেকে এসএএম কর্নারে শিশুর তীব্রতম অপুষ্টির চিকিৎসা শুরু করা হয়।

জাতীয় পুষ্টি সেবার (এনএনএস) ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. গাজী আহমদ হাসান জানান, সারা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় বর্তমানে ৪১০টি স্যাম কর্নার রয়েছে। এসব কর্নারে প্রশিক্ষিত নার্স ও চিকিৎসকের মাধ্যমে দুই-তিন সপ্তাহব্যাপী নিবিড় সেবার মাধ্যমে শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সব কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সেবা দিয়ে শিশুদের চিকিৎসার জন্য এসব হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে এ কর্মসূচিও উপকরণের অভাবসহ নানা সংকটে ধুঁকছে।

তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মা-বাবার অসচেতনতাও সংকট মোকাবিলায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের লাইন ডিরেক্টর ডা. এসএম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, স্যাম কর্নার মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল। আমরা তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায় কাজ করছি। সারা দেশে ধীরে ধীরে আমাদের কর্নার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু ভর্তিও বেড়েছে। এ কর্নারে ভর্তি শিশুর বেশির ভাগই দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত। শিশুর সঙ্গে মা অথবা বাবাকে থাকতে হয়। এতে তাদের আয় ওই সব দিন বন্ধ থাকে। তাই ভর্তি হওয়ার সপ্তাহের মাথায় যখন শিশুটি কিছুটা সুস্থ হয়, তখন তাকে জোর করে নিয়ে যায় অথবা আমাদের না জানিয়ে চলে যায়। পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হয়। কিন্তু আমরা এখানে তাদের সচেতনতা পাই না।

‘বাংলাদেশের শিশুপুষ্টি পরিস্থিতি: বিদ্যমান অবস্থা ও উন্নয়নের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ সাপোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশে অপুষ্টির কারণে প্রতি বছর কমপক্ষে সাত হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। শিশুর অপুষ্টি দূর করতে বহুপক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন। অনেক অর্থ খরচ করার পরও এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিংয়ের হার এখনো ৫০ শতাংশে আটকে আছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ নিয়ে কাজ করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুমাইয়া মামুন সিমরান আমার দেশকে বলেন, শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে আগে মায়ের পুষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে হবে। মা নিজে অপুষ্টির শিকার হলে তার গর্ভের সন্তানের ওপরও সে প্রভাব পড়বে। সুতরাং মা শুধু নিজের জন্য খাচ্ছেন না, তিনি তার শিশুর জন্য খাচ্ছেন এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। শুধু গর্ভাবস্থায় নয়, শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময়ও মায়ের পুষ্টির প্রয়োজন আছে। একই সঙ্গে মায়ের অতিরিক্ত ওজনও কিন্তু ক্ষতিকর। এর কারণে শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়, যা পরবর্তী সময় শৈশব স্থূলতার কারণ হতে পারে।

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান আমার দেশকে বলেন, শিশুর জীবনের প্রথম ২৪ মাসে পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু প্রথমত মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে পুষ্টি পায়। শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধই একমাত্র খাবার। একে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং (ইবিএফ) বলা হয়। মা সঠিকভাবে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করালে শিশু অনেক ঝুঁকি থেকে রক্ষা পায়। বাংলাদেশে ইবিএফের হার কমে ৫২ শতাংশে নেমে এসেছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত