জুলাই বিপ্লবের সাত মাস পার হলেও এখনো বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আওয়ামী দোসরদের কব্জায়। একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) বদলি ছাড়া এ সময়ের মধ্যে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং বিগত সময়ে দুর্নীতির দায়ে বোর্ডে সংযুক্ত পরিচালক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা রেজাউল করিমকে নতুন করে পদায়নে ব্যাপক তোড়জোড় চলছে। এ নিয়ে পাউবো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সারা দেশে পাউবোর অধিগ্রহণ করা দুই লাখ ২২ হাজার একর জমির লিজ বাণিজ্যে সক্রিয় ছিলেন ফ্যাসিবাদের দোসর ভূমি রাজস্ব পরিদপ্তরের পরিচালক (ওএসডি) রেজাউল করিম।
পাউবোর শত শত একর জমি নামে-বেনামে, লিখিত ও মৌখিকভাবে লিজ দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েন তিনি। জুলাই বিপ্লবের পর তার অপকর্মের খতিয়ান প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। অবৈধ আয়ে শুধু বনানীতেই কেনেন বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাট। কোটি টাকার এফডিআরসহ দামি গাড়ি-বাড়িও করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিম ও উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীমের ক্ষমতা ব্যবহার করে পাউবো থেকে ভূমি লিজ দেওয়া সম্পর্কিত একটি দপ্তরাদেশ জারি করে দুর্নীতির লাইসেন্স নিজের কব্জায় নেন এই রেজাউল।
রেজাউল করিম পাউবোর বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতির দায়িত্ব নিয়ে যেন দুর্নীতি করার লাইসেন্স হাতে পান। সিনিয়র কয়েকজনকে ডিঙিয়ে উপপরিচালক থেকে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ভূমি ও রাজস্ব পরিচালক পদে পদোন্নতি আদায় করেন। এরপর আর তার লাগাম টেনে ধরা যায়নি। ঘুস-দুর্নীতির অভিযোগে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জের ক্ষমতায় দুই মাসের মাথায় ২০২০ সালের ১৯ মার্চ আবারও তিনি ভূমি-রাজস্ব পরিদপ্তরে পোস্টিং নিয়ে ফিরে আসেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর অবৈধ হস্তক্ষেপে পাউবোতে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হন তিনি। এ কর্মকর্তা ঢাকা সিটিসহ সারা দেশে আওয়ামীপন্থি ‘নীল দল’-এর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। পাউবোর অধিগ্রহণ করা দুই লাখ ২২ হাজার একর এবং ঢাকা শহরের ৩৫ হাজার একরের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার একর জমি নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে লিখিত ও মৌখিকভাবে লিজ প্রক্রিয়ায় ঘুস-দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েন এই কর্মকর্তা।
রেজাউল করিম বাসা ভাড়া ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাদ দিয়ে প্রতি মাসে বেতন পান প্রায় ৬০ হাজার টাকা। অথচ ২০১৯ সালে ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তরে যোগদানের পর তার সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছরে তিনি কোটি কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক হন।
শুধু বনানীতেই তিনি আলিশান দুটি ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দেন। ফ্ল্যাট দুটির বাজারমূল্য অন্তত ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। বনানী ‘আই’ ব্লকে ১ নম্বর রোডে ২১ নম্বর প্লটে আধুনিক ডিজাইনে নির্মিত ভবনে তার ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই দলিলে দুই হাজার ৭১৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক রেজাউল করিম। স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের নামে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বনানীর ‘কে’ ব্লকে। ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর এক হাজার ৫৬০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি রেজিস্ট্রি হয় গ্যারেজসহ।
এ ছাড়া ঢাকার উত্তরায় রয়েছে তার দুই হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। মিরপুরে একটি এক হাজার ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, উত্তরায় ৫ কাঠার প্লট এবং কক্সবাজারে স্যুট লবি ক্রয় করেন। জামালপুর সদরের বেলটিয়ায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, লেটেস্ট মডেলের একাধিক গাড়ি আছে তার। এর মধ্যে ঢাকায় এলিয়ন গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ফাইন্যান্স কোম্পানি আইপিডিসি, জাতীয় সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার নামে, স্ত্রী-সন্তানদের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার এফডিআর ও সঞ্চয়পত্র।
তার বিরুদ্ধে এতসব অভিযোগ থাকার পরও অদৃশ্য কারণে দুদক নীরব রয়েছে। এ ছাড়া বিভাগীয় ব্যবস্থা না নিয়ে এই আওয়ামী কর্মকর্তাকে নতুন করে পদায়নের খবরে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে রেজাউল করিমের বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ না করে টেক্স করতে বলেন। পরে হোয়াটসঅ্যাপে তার বক্তব্য জানতে চেয়ে টেক্স করা হলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
নাম ও পদবি প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, এ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি দুর্নীতিবাজ রেজাউল করিমকে পাউবোতে পদায়ন করা হলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, ওপর লেভেলে যে যা-ই করুক না কেন, রেজাউল করিম যোগদানের চেষ্টা করলে সবাই মিলে প্রতিরোধ করা হবে। নতুন করে ফ্যাসিবাদের দোসরকে কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।
অভিযুক্ত রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলাকালীন তার পদায়নের চেষ্টার বিষয়ে পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোল্লা মিজানুর রহমান বলেন, ‘অল্প কিছুদিন আগে এখানে এসেছি। এ বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। রেজাউল করিমের পদায়নের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে।
পাউবোর মহাপরিচালক তাহমিদুল ইসলাম বলেন, অলস বসে বসে যাতে বেতন-ভাতা ভোগ না করতে পারে, সে জন্য তাকে অগুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের চিন্তা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে কোনো ব্যত্যয় হবে না।
ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো উচ্চপদগুলোয়
এদিকে পাউবো সূত্র জানায়, ফ্যাসিবাদের সমর্থকরা এখনো বাপাউবোর উচ্চপদগুলো দখল করে আছে। আগের মহাপরিচালক কিছু পদে পরিবর্তন আনার আশ্বাস দিয়েও শেষ পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন না করেই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের স্ব-স্ব স্থানে রেখেই তিনি অবসর-উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যান।
অন্যদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়েও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে স্বৈরাচার হাসিনার নিয়োগ দেওয়া সচিবদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান দিব্যি স্বপদে চাকরি করে যাচ্ছেন। এদিকে নাজমুল আহসান ওপর মহলকে ম্যানেজ করে পদ টিকিয়ে রাখছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
এ ছাড়া বাপাউবোর বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারাও বহালতবিয়তে দাপটের সঙ্গে চাকরি করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে যেসব কর্মকর্তা বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে বঞ্চিত ছিলেন, তারা এখনো বঞ্চিতই রয়ে গেছেন। পানিসম্পদ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বাপাউবোর নিয়ন্ত্রণ এখন সচিব ও মন্ত্রণালয়ের হাতে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী সচিব বাপাউবোতে কোনোরকম পরিবর্তনের পক্ষে নন বলে জানা যায়।
বাপাউবোর তিনজন প্রকৌশলীর একজন সরাসরি বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা। তিনি এখনো অতিরিক্ত মহাপরিচালকের পদে আসীন। অন্যদিকে, বাপাউবোর ঢাকা পানি উন্নয়ন সার্কেল-১ ও ঢাকা পানি উন্নয়ন সার্কেল-২-এ বঙ্গবন্ধু পরিষদের দুজন নেতা এখনো কর্মরত। বাপাউবোতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের সবচেয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দুজন ফ্যাসিবাদের দোসর কর্মরত থাকলেও বাপাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের সরাতে নারাজ। অথচ বিগত দিনে এরাই বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের অত্যাচার-নির্যাতনে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দুই কর্মকর্তা সুচতুর। তারা বাপাউবোর ঊর্ধ্বতন দপ্তরসহ মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে রেখেছেন।
ঢাকা পানি উন্নয়ন সার্কেল-১-এর আওতায় ঢাকা, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুর জেলা। এখানকার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেওয়ান আইনুল হক নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সাবেক সহসভাপতি পদে ছিলেন। তিনি সর্বশেষ ইউকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের ব্যানারে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ঢাকা পানি উন্নয়ন সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীও পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

