ভারতের ‘র’-এর এজেন্ট ছিলেন এনএসআই কর্মকর্তা বদরুল-পলাশ

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ৩১
আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ৪৯

জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স-এনএসআইয়ের তিন কর্মকর্তা বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এদের দুজন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এ এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন এবং এরা এনএসআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিও চুরি করে নিয়ে গেছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

এই কর্মকর্তারা হলেন-এনএসআইয়ের যুগ্ম পরিচালক বদরুল আহমেদ (বিদ্যুৎ), উপ-পরিচালক আমিনুল হক পলাশ ও সহকারী পরিচালক তানভীর হোসেন খন্দকার। দুবাই কনস্যুলেট, কলকাতা মিশন এবং ঢাকা থেকে এরা পালিয়েছেন। আমিনুল হক পলাশ বিকল্প পাসপোর্টে ভারত থেকে ব্রিটিশ ভিসা নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে গেলেও অন্য দুই কর্মকর্তা কোন দেশে পালিয়ে গেছেন এনএসআইয়র সদর দপ্তর এখনো জানতে পারেনি। এ ঘটনা গোয়েন্দা সংস্থাটিতে রহস্যের সৃষ্টি করেছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, পলাতক তিন কর্মকর্তার মধ্যে উপ-পরিচালক আমিনুল হক পলাশ প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের দায়ের করা সব মামলা ও তাকে হয়রানির কারিগর হিসেবে পরিচিত। ‘র’-এর এজেন্ট হিসেবে কাজ করার কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য তিনি ‘র’-এর কাছে পাচার করেছেন। ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্টধারী হলেও বেআইনিভাবে রাখা বিকল্প পাসপোর্ট (সবুজ পাসপোর্ট) নিয়ে তিনি লন্ডনে পালিয়েছেন এবং সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন বলে কলকাতার কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। স্বপক্ষ ত্যাগ করে এভাবে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে এখনো রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়নি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, কলকাতা ও দুবাই থেকে পালিয়ে যাওয়া এনএসআইয়ের দুই কর্মকর্তাকে দেশে তলব করলেও তারা আসেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নোটিস জারির পর তাদের ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট (লাল পাসপোর্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাতিল করেছে।

পলাতক কর্মকর্তা আমিনুল হক পলাশ সম্পর্কে আরো জানা গেছে, এনএসআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) টিএম জোবায়ের শেখ হাসিনার নির্দেশে তাকে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পেছনে লাগিয়েছিলেন। তার কাজ ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা। এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য মামলায় ড. ইউনূসকে ফাঁসানো, জেলে বন্দি করা, আদালত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া এবং তার আন্তর্জাতিক সম্মান ও মানমর্যাদা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।

পলাতক যুগ্ম পরিচালক বদরুল আহমেদও ‘র’-এর হয়ে কাজ করেছেন। তার দায়িত্ব ছিল ২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করা। তিনি এনএসআইয়ের তৎকালীন ডিজি টিএম জোবায়েরের বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গেও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। পলাতক সহকারী পরিচালক তানভীর জাল সার্টিফিকেট দিয়ে এনএসআইয়ের চাকরিতে যোগদান করেন। তার বাবা এম খুরশীদ হোসেন র‌্যাবের সাবেক ডিজি, তিনিও পালিয়েছেন।

এনএসআই কর্তৃপক্ষ সংস্থাটির তিন কর্মকর্তা পালানোর বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করে আমার দেশকে জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পলাতক উপ-পরিচালক আমিনুল হক পলাশের ব্যাপারে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাকে (এমআই-৬) ইতোমধ্যে অবহিত করা হয়েছে। পলাশ সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। ড. ইউনূসকে ফাঁসানোর পুরস্কার হিসেবে পলাশকে কলকাতায় পোস্টিং দেওয়া হয়। তাকে দেশে তলব করা হলে তিনি আর্টিকেল ৪৭ অনুযায়ী দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এর আট কর্মদিবসের মধ্যে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে রিপোর্ট করার কথা। কিন্তু তিনি বহিঃবাংলাদেশ ছুটির আবেদন করেন। এই সময়টায় তিনি ব্রিটিশ ভিসা নেওয়ার চেষ্টা চালান।

এনএসআই কর্তৃপক্ষ আরো জানায়, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে এনএসআইতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে এই তিন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। এদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে ফাইল পাঠানো হয়েছে।

পলাতক কর্মকর্তা বদরুল আহমেদের প্রেষণের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর সাত মাস আগে তাকে দায়িত্ব ত্যাগ করে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের ১৮ আগস্ট এ বিষয়ে চিঠি পাঠায় কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত কর্মস্থলে যোগ দেননি। কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার ৬০ দিন পার হওয়ায় তাকে পলাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ডিজারশনের অভিযোগে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার অফিসে ফাইল পাঠানো হয়েছে।

এনএসআইয়ের পলাতক যুগ্ম পরিচালক বদরুল আহমেদ (বিদ্যুৎ) ছাত্র জীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২০১১ সালে এনএসআইয়ের ফিল্ড অফিসার হিসেবে যোগদান করে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি সহকারী পরিচালক হন। তিনি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার নির্বাচন জালিয়াতির ক্ষেত্রে ‘কী-রুল’ পালন করেন। ২০২৪ সালের আগে তিনি দুবাইতে কনস্যুলার অ্যাটাচি হিসেবে (দ্বিতীয় সচিব) কাভার পদে ছিলেন। সেখানে তিনি ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ থেকে কর্মরত ছিলেন। ২০২৪-এর নির্বাচনে তাকে দুবাই থেকে ঢাকায় এনে নির্বাচন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজে নিয়োগ করা হয় এবং সংস্থার নির্দেশ মতো তিনি হাসিনা সরকারের পক্ষে কাজ করেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি দুবাই থেকে বিকল্প পাসপোর্ট নিয়ে পালিয়ে যান।

এনএসআইয়ের বক্তব্য

তিন কর্মকর্তার বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে এনএসআইয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র আমার দেশকে জানান, পলাতক তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। তাদের নানা বেআইনি কার্যক্রম, রাজনৈতিক/শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে। এনএসআইয়ের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং নিয়মশৃঙ্খলা শক্তভাবে প্রতিষ্ঠার সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এনএসআইয়ের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য বর্তমান কর্তৃপক্ষ কাজ করছে এবং এ ব্যাপারে বর্তমান মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবু মোহাম্মদ সরোয়ার ফরিদ খুবই আন্তরিক।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত