জুলাই সনদের খসড়া, দুই বছরের মধ্যে শেষ হবে সংস্কার

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৭: ১০
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৪২

অভ্যুত্থানের পর থেকেই জুলাই সনদ নিয়ে চলছে আলোচনা। বিশেষত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই সনদ ঘোষণার দাবিতে সরকারকে আল্টিমেটার দিয়ে রেখেছে। দলটি আগামী মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। তাদের এ দাবির প্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতোমধ্যে জুলাই সনদ তৈরি করেছে। জুলাই সনদের খসড়ার একটি অংশ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। এটি আজ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। আগামী ৩০ জুলাই, ২০২৫ তারিখ রোজ বুধবার দুপুর ১২.০০টার মধ্যে খসড়ার এই অংশের বিষয়ে তাদের মতামত প্রদানের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্রে এটা জানা গেছে।

সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেই চূড়ান্ত সনদ তৈরি করা হবে। জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ও ঘোষণার পাশাপাশি সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেই জুলাই সনদ চূড়ান্ত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যস্ততায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পর পর ২০ দিন বৈঠক শেষে এ খসড়া তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। এর আগে একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েক দফায় বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয় ৬টি সংস্কার কমিশনের প্রধানকে নিয়ে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রিয়াজ কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বৈঠকগুলোতে সভাপতিত্ব করেন।

সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কতদূর: এখন পর্যন্ত যেসব সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহায়তায় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পূর্নপ্রবর্তন, একজন ব্যাক্তির সবোর্চ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকা, সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করে দ্বিক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, নারী আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের ব্যাপারে দলগুলো একমত হয়েছে বলেছে যে, জাতীয় সংসদে অর্থবিল ও আস্থাভোট ছাড়া সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন সংসদ সদস্যরা। তবে বিষয়টিতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। দলটি জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় গেলে দুটোর সঙ্গে সংবিধান সংশোধন এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে দলের বিপক্ষে এমপিরা ভোট দিতে পারবেন না, এ বিধান যুক্ত করবে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ব্যাপারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে করা সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকারি হিসাব কমিটি, অনুমিত হিসাব কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি ও বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি—এই চারটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি যিনি হবেন বিরোধী দল থেকে নেওয়া হবে। চারটি স্থায়ী কমিটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোতে সংখ্যা আনুপাতিক হারে বিরোধী দল থেকে সভাপতি পদ দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো।

নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়। এরপর প্রতি আদমশুমারি অনধিক ১০ বছর পর সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের জন্য সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের দফা একের ‘ঘ’ শেষে আইনের দ্বারা একটি বিধান যুক্ত করা। এর অর্থ হচ্ছে, সংসদীয় আসন নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়ে একটি সুপারিশ কমিটি বা বোর্ড গঠন করা হবে। এ কমিটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমার বিষয়ে পরামর্শ দেবে।

বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনে একমত হয়েছে দলগুলো। তবে বিএনপির পক্ষে প্রস্তাব করা হয়েছে বিষয়টির জন্য সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে হবে। নাগরিক সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে অধস্তন আদালত স্থাপনে একমত হয়েছে দলগুলো। একই সঙ্গে বিদ্যমান চৌকি আদালত, দ্বীপাঞ্চল ও ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত উপজেলা আদালতকে স্থায়ী আদালত করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছে দলগুলো।

প্রধান বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগ থেকে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট নির্বাচনে ইশতেহার-পূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারপতি থেকে একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করবেন। এমন বিধান সংযোজন করতে পারবে। তবে অসদাচরণ বা অসামর্থ্য অভিযোগের কারণে ৯২ অনুচ্ছেদের অধীন কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান থাকলে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।

জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, ১৪১-এর ক(১) ধারা মতে, রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, যা যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের দ্বারা বাংলাদেশ বা এর যেকোনো অংশের নিরাপত্তার বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহলে তিনি অনধিক নব্বই দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার আগেই মন্ত্রিসভার লিখিত অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা বা বিরোধীদলীয় উপনেতা উপস্থিত থাকবেন।

সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ, উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট। নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ, উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, গণভোটের ব্যবস্থা না থাকা এবং উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ এবং সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট। বিদ্যমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্তির পর ভবিষ্যতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে।

দ্বিকক্ষের সংসদের বিরোধিতা করছে সিপিবি ও বাসদ। বাকি ২৮টি দল একমত। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি, এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টনের মতো উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন সংখ্যানুপাতিকে উভয় কক্ষের নির্বাচনের দাবি করেছে। এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, জেএসডি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ বাকি ২১টি দল সংখ্যানুপাতিকে (পিআর) উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করেছে।

সংসদে নারী আসন বাড়ানোর পক্ষে অধিকাংশ দলই একমত। বিএনপি ও তার সমমনা চারটি দল বিদ্যমান ব্যবস্থায় আসন বণ্টনের পক্ষে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন হলে ১০০ আসনের পক্ষে। এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি, বাসদসহ কয়েকটি দল সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে।

বিএনপি ও তার সমমনা চারটি দল এবং জোট সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে। জামায়াতসহ অধিকাংশ দল ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে। দু-একটি দল সরাসরি ভোট চেয়েছে।

বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল কমিশনের প্রস্তাবিত পাঁচটি মূলনীতির পাশাপাশি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত হওয়া আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস যুক্ত করার পক্ষে। এনসিপি কমিশনের প্রস্তাবে একমত। সিপিবি, বাসদসহ বামপন্থি দলগুলো কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে বিদ্যমান মূলনীতি রাখার পক্ষে।

সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি (আগে ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল-এনসিসি)। প্রস্তাবটিতে আপত্তি বিএনপি, এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের। এ ছাড়া জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, সিপিবি, বাসদসহ সংলাপে অংশ নেওয়া বাকি ২৪টি দল প্রস্তাবের পক্ষে।

জুলাই সনদের খসড়ার ব্যাপারে ২/৩ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চূড়ান্ত মতামত দিবে। সেটা বিবেচনায় নিয়ে ৫ আগস্টের আগেই জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার কথা। রাজনৈতিকগুলোর নেতৃবৃন্দেরে স্বাক্ষরসহ জুলাই সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আসছে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারে পতন দিবস ও জুলাই বিপ্লবের বার্ষির্কী ও ৮ আগস্ট ড. ইউনূস সরকারর দায়িত্ব গ্রহণের বছরপূর্তির মধ্যে যেকোনো দিন জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে। সেদিন তিনি নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ইতোপূর্বে ঘোষিত আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধের পরিবর্তে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিতে পারেন। জুলাই সনদে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে মতৈক্য প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে সেগুলো নিয়ে শেষ মুহূর্তের আলোচনা এখনো চলছে। এরই মধ্যে সনদের মুখবন্ধসহ অন্যান্য বিষয়ে একটি খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে তাদের মতামত চাওয়া হয়েছে।

সংস্কার সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া জুলাই সনদের খসড়ার বাকি অংশ

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ (খসড়া)

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সফল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও শক্তিসমূহের প্রতিনিধিরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি-

১। পটভূমি

১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক সুবিচারের নীতিকে ধারণ করে সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের আকাক্সক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি। কারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংষ্কৃতি বিকাশের ধারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। বস্তুতপক্ষে, বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একদিকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অপরদিকে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নামেমাত্র থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বলভাবে কাজ করেছে। বস্তুত রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দলীয় প্রভাবের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে পরিচালনা করা হয়েছে।

২০০৯ সালে একটি দলীয় সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করতে থাকে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের মানবাধিকার হরণ, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা ও হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট করে।

এই পটভূমিকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব সফল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চারশোর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

এমতাবস্থায় জনগণের মননে রাষ্ট্র-কাঠামো পুনর্গঠনের একটি প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংষ্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করা আমাদের সকলের পবিত্র দায়িত্ব।

২। সংস্কার কমিশন গঠন

বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রেরিত প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো হচ্ছে: সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলো ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখের মধ্যে সুপারিশসহ সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে।

৩। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সার্বিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানকে সহ-সভাপতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। পরবর্তীতে উক্ত কমিশন কিছুটা পুনর্গঠন করা হয়। কমিশনের দায়িত্ব ছিলÑ আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা করা এবং এ মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করা। কমিশনের মেয়াদ ছিল কার্যক্রম শুরুর তারিখ থেকে ছয় মাস। কমিশন তার দায়িত্ববোধ ও সুপারিশের অংশ হিসেবে ঐকমত্যের মৌলিক বিষয় সম্বলিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়।

৪। কমিশনের কার্যক্রম

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখের মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে প্রেরণ করা হয়। এরপর ৫ মার্” ২০২৫ তারিখে পুলিশ সংস্কার কমিশন ব্যতীত অপর পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ক ২৭টি সুপারিশ ছিল। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি। অপরদিকে, সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে প্রেরণ করে, অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও প্রদান করে। মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে ২০২৫ পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে কিছু দলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ২০টি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় মিলিত হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে নিম্নলিখিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ রচিত হয়।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, আমরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা স্ব স্ব দলের পক্ষ থেকে বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশী ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে নিম্নোল্লেখিত কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি এবং এইসব বিষয়সমূহকে একটি জাতীয় সনদে সন্নিবেশিত করতে সম্মত হয়েছি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ এবং উক্ত গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে আমরা এই সনদকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ হিসেবে ঘোষণা করছি।

৫। ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার বিষয়সমূহ

(পরে যুক্ত হবে)

--------------------------------------------------------------------------------------------

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------- (এই অংশে প্রথম পর্বের আলোচনা এবং চলমান দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শেষে যে সকল বিষয় একত্রিত হবে সেই সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে।)

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা

আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে,

১) হাজারো মানুষের জীবন ও রক্ত এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব;

২) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ দেশের শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশী ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি;

৩) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ দেশের শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশী ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন এই সনদ গৃহীত হওয়ার পরে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে এবং এসব সংস্কার টেকসই করতে অঙ্গীকার করছি।

৪) এই সনদ গৃহীত হওয়ার পর এতে যে সমস্ত প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো পরবর্তী দুই (২) বছর মেয়াদকালের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি;

৫) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করব;

৬) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে এবং এর আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদানে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; এবং

৭) ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকব।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ/প্রতিনিধির স্বাক্ষর

ক্রমিক নম্বর নাম ও পদবী রাজনৈতিক দল/জোটের নাম স্বাক্ষর

১.

২.

৩.

৪.

৫.

৬.

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের স্বাক্ষর

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষর

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত