ইসলামি ভাবধারা থেকে যেভাবে বামপন্থি হন বদরুদ্দীন উমর

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮: ০৪
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮: ৫৬

লেখক-গবেষক, রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রোববার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে বদরুদ্দীন উমরের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।

মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, লেখক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে।

বিজ্ঞাপন

বদরুদ্দীন উমর তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শুরুর দিকে তার চিন্তা-ভাবনায় ইসলামি প্রভাব থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সে সময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা এবং জানাশোনা বাড়তে থাকে। তবে, অক্সফোর্ডে পড়তে যাওয়ার পর তার মার্কসপন্থি চিন্তা-ভাবনা পূর্ণতা পায়।

বদরুদ্দীন উমরের বাবা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। পঞ্চাশের দশকে তার বাবা ঢাকায় 'খেলাফত-ই-রব্বানী পার্টি' নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ইসলামি আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করাই ছিল এ দলের আদর্শ।

২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, জীবনের শুরুর দিকে বাবার প্রভাবে তার মধ্যে 'এক ধরনের ইসলামি চিন্তার আচ্ছন্নতা ছিল'। যে কারণে ভারত থেকে ঢাকায় আসার পরও তিনি তমুদ্দিন মজলিসের সঙ্গে বেশ কিছুদিন সম্পৃক্ত ছিলেন।

রাজনীতি ও চিন্তা

বদরুদ্দীন উমর ইংল্যান্ড থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরলেও রাজনীতিতে যুক্ত হন আরও পরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়ার পর তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট ধারায় রাজনীতি শুরু করেন।

দেশে ফেরার পর প্রথমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ত্যাগ করে সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যোগ দেন।

পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন।

অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, অক্সফোর্ডে আন্তর্জাতিক বামধারার ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পড়াশোনা তার মধ্যে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বোধ তৈরি করে।

‘অক্সফোর্ডে তিনি সেরকম (বামপন্থি) মানুষজনের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, কাজ করেছেন, কথা বলেছেন, গবেষণা করেছেন। তার বিষয় যেহেতু ছিলো রাজনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি -এই বিষয়গুলো নিয়েই তিনি পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে।’

‘দেশে ফেরার পর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক বোধ বা বুদ্ধিবৃত্তিক যে দায়বোধ সেটা তার মধ্যে শক্তিশালী ছিল।’

বদরুদ্দীন উমর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন কিছুকাল। সেখানে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। এসময় দেশে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বহু লেখা লেখেন। সে লেখাগুলো বাঙালির লড়াই, উপলব্ধি ও আত্ম অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলেই গবেষকরা মনে করেন। তবে শেষপর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বদরুদ্দীন উমর। শিক্ষকতার চাকরি ছাড়েন।

১৯৬৮ সাল থেকে তিনি বামধারার রাজনীতিতে চীনাপন্থি অংশের সঙ্গে যুক্ত হন। চীনাপন্থি বলে পরিচিত সুখেন্দু দস্তিদার, তোয়াহা, আব্দুল হকদের সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরে তিনি আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতায় ফেরেননি। লেখালেখি ও বামপন্থি রাজনীতির চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

বদরুদ্দীন উমর ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটা সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সভাপতির দায়িত্ব নেন।

‘ইউরোপীয় কনসেপ্টে যেটা বলা হয় বা লাতিন আমেরিকায়ও এই জিনিসটা আছে সেটা হচ্ছে, 'অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল'। অর্থাৎ তিনি বুদ্ধিজীবী কিন্তু গণআন্দোলন বিবর্জিত না। তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এবং রাজনীতির যে টানাপোড়েন আছে বা কন্টেম্পোরারি যে মুভমেন্টগুলো আছে সেটাতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তার মূল কাজটি হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ।’ বলেন মহিউদ্দীন আহমদ।

১৯৭৩ সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের সঙ্গে নীতিগত বিরোধ থাকার কারণে তিনি সেই পুরস্কার গ্রহণ করেননি।

চলতি বছর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষিত হলেও তিনি সেটা গ্রহণ করেননি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়ে দেন, ‘এই পুরস্কার গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’

‘১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটি গ্রহণ করিনি। এখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। এজন্য তাদেরকে ধন্যবাদ।

কিন্তু তাদের দেওয়া এই পুরস্কারও গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে লিখেছিলেন বদরুদ্দীন উমর।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত