বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) কর্তৃক ইউনিসেফের কারিগরি সহায়তায় পরিচালিত ২০২৫ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (MICS)-এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। এই মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার জরিপটি ১৭২টি ইনডিকেটর (যার মধ্যে ২৭টি এসডিজি-সম্পর্কিত) মাধ্যমে বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে একটি সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ চিত্র তুলে ধরেছে।
বুধবার জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এর পাঠানো একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাথমিক ফলাফলগুলো মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের সূচকের অগ্রগতিতে ভীষণ আশাব্যঞ্জক। এখানে উল্লেখ্য যে, শিশু মৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে; ২০১৯ সালে যেখানে প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মে ৩৪টি শিশু মারা যেত, ২০২৫ সালে তা কমে ২৯-এ দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি, মাতৃস্বাস্থ্য সেবা প্রদানের পরিসরেও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে ৭১ শতাংশ প্রসব স্বাস্থ্য- প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে এবং ৭৭ শতাংশ প্রসব দক্ষ প্রসব সহায়তাকারীদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হচ্ছে, যা ২০১৯ সালের MICS জরিপের তুলনায় সুস্পষ্ট অগ্রগতি।
জনস্বাস্থ্য পরিষেবার ফলাফল উন্নত করতে এবং সেবা বিতরণ ব্যবস্থা জোরদার করতে বাংলাদেশ সরকারের ধারাবাহিক প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন হলো এই ইতিবাচক দিকগুলো। এই সফলতার জন্য ইউএনএফপিএ, বাংলাদেশ সরকারকে অভিবাদন জানায়। গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে ইউএনএফপিএ এই প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় সহায়তা করে আসছে— বিশেষতঃ মিডওয়াইফারি শিক্ষা ও সেবা চালুর মাধ্যমে ইউএনএফপিএ একটি নিবেদিত মাতৃ- স্বাস্থ্যসেবা কর্মী গঠন, মাতৃস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুদৃঢ়করণ, এবং মা ও নবজাতকের জন্য মানসম্পন্ন সেবার উন্নয়নে ভূমিকা রেখে আসছে।
এই সফলতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কিছু সূচক এখনও উদ্বেগের কারণ। বাল্যবিবাহ সামান্য কমলেও এখনও তা সমাজে উদ্বেগজনক হারে বিদ্যমান। ২০-২৪ বছর বয়সী মহিলাদের ১৮ বছর বয়সের আগে বিবাহিত হওয়ার হার ২০১৯ সালে ৫১.৪ শতাংশ থেকে কমে ২০২৫ সালে ৪৭.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে বাল্যবিবাহ রোধে ত্বরান্বিত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অন্যদিকে, ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েদের যারা বর্তমানে বিবাহিত তাদের অনুপাত ৩২.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৮.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং, ইউএনএফপিএ মনে করে যে, বাল্যবিবাহ বন্ধের বর্তমান ধীর গতি বজায় থাকলে, বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে ২০০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।এটি জেন্ডার সমতা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তাছাড়া ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে জন্মহার ৮৩ থেকে বেড়ে ৯২ হওয়া ইঙ্গিত দেয় যে, বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে মা হওয়া এবং এর ফলে স্বাস্থ্য ও সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মধ্যে একটি জোরালো যোগসূত্র রয়েছে।
MICS-সার্ভের ফলাফলে প্রজনন হারেরও পরিবর্তন প্রকাশ পেয়েছে । মোট প্রজনন হার সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যার একটি কারণ আংশিকভাবে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রাপ্তিতে বিঘ্ন ঘটে এবং পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের হার হ্রাস পায়, যা এখন ৫৮.২ শতাংশ। যদিও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির অপূর্ণ চাহিদা কিছুটা সামঞ্জস্য রয়েছে তবে আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণে নারীদের কাছে পৌঁছানর সুযোগের অভাবে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অধিকার-সচেতন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কৌশল (২০২৫-২০৩০) প্রকাশ করেছে, যা নীতিগত ক্ষেত্রগুলো শক্তিশালী করতে এবং মানসম্পন্ন পরিবার পরিকল্পনা সেবার সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে একটি মানবাধিকার-ভিত্তিক কাঠামো সরবরাহ করতে সহায়তা করবে। এই বছরের শুরুতে সরকার জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০২৫-ও নবায়ন করেছে, যা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য থেকে অধিকার ও পছন্দের উপর জোর দেওয়া হয়েছে যা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই নীতিমালায় শৈশব থেকে বয়স্ক অবস্থা পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি স্তরের সম্ভাবনা পূরণের জন্য একটি জীবনচক্র পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে কিশোর এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর মানব সম্পদ যেমন শিক্ষা, কর্মসংস্থান, জীবন দক্ষতা, স্বাস্থ্য, সুস্থতা এবং জেন্ডার সমতার উপর। ইউএনএফপিএ এই উভয় কৌশলপত্র প্রণয়নে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে অধিকার-ভিত্তিক পদ্ধতির গুরুত্বকে পুনর্ব্যক্ত করেছে।
এদিকে, অস্ত্রোপচারজনিত (সি-সেকশনে) প্রসবের হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০১৯ সালের ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫১.৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগের ব্যাপার। এর কারণ হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে গর্ভধারণ ও স্বাভাবিক প্রসবের জন্য মাতৃ স্বাস্থ্যসেবায় মানব সম্পদের অভাব এবং চিকিৎসার অত্যধিক ব্যাবহার অন্যতম। বিশেষত, বেশিরভাগ সি-সেকশনই যখন বেসরকারি ও নিয়ন্ত্রণহীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হচ্ছে, তখন এই উদ্বেগ আরও বাড়ছে। এই প্রবণতা এবং অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার, নিম্নমানের সেবা এবং অনিরাপদ অস্ত্রোপচারের কারণে সৃষ্ট অস্ত্রোপচার-জনিত ফিস্টুলা (ইয়েট্রোজেনিক ফিস্টুলা) -এর ঝুঁকি বাড়ায়, অন্যদিকে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে সময়মতো জরুরি প্রসূতিসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ঘাটতি যা পূরণ করলে যে মায়েরা প্রসব জনিত জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন তা সহজেই এড়ানো যায়।
অস্ত্রোপচারজনিত প্রসব অতি দরিদ্রদের তার নিজের পকেট থেকে খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, যা তাদের জন্য মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ দ্রুত নিয়োগ, সময়মতো রেফারেল, নিরাপদ অস্ত্রোপচার নিশ্চিতকরণ এবং ক্লিনিক্যাল তদারকি ও ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করা অত্যাবশ্যক।
প্রসবের ঠিক পরে মায়ের খিঁচুনি, প্রসবের আগে ও পরে রক্তপাত, অতিরিক্ত সময়ের প্রসব বেদনা, এবং শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করার হার এর তথ্যগুলো কিছুটা উদ্বেগজনক। এই উদ্বেগগুলি হলো: গর্ভকালীন সময়ে সেবার মান কেমন এবং কতবার সেবা দেওয়া হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার সঠিক যত্ন নেওয়া হচ্ছে কি না, এবং জন্মদান ও পরবর্তী সময়ে মা ও নবজাতকের পরিচর্যা কেমন হচ্ছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় লেবার রুম প্রোটোকলের ব্যাবহার, প্রসবের পর রক্তক্ষরণ ঠেকানো এবং খিঁচুনি মোকাবিলার কর্মপরিকল্পনা তাড়াতাড়ি চালু করা এবং মিডওয়াইফদের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসবের পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী।
প্রাপ্ত তথ্যে স্পষ্ট যে, জরুরি ভিত্তিতে অধিকার-ভিত্তিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিগুলোর পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকতে হবে এবং সরকারি হাসপাতালে মা-শিশুর যত্নের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক মিডওয়াইফ ও স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ করতে হবে। কিশোরী গর্ভাবস্থা রোধ, দেরিতে বিয়ে এবং পড়ালেখার চালু রাখার প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া, বাল্যবিবাহ ও জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা রোধ, ক্ষতিকর সামাজিক নিয়মগুলো পরিবর্তন করা অত্যন্ত আবশ্যক। মেয়েদের সম্ভাবনার বিকাশে, সরকারি নেতৃত্ব ও বাজেট বিনিয়োগের পাশাপাশি সুশীল সমাজ, মিডিয়া এবং তরুণদের মতো পরিবর্তনের কারিগরদের সক্রিয় অংশগ্রহণও জরুরি।
বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন, "বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে দ্রুত এগিয়ে চললেও, নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্য, অধিকার ও শিক্ষায় বিনিয়োগই হলো এই সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি।"
ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ সরকারের একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সর্বদা পাশে থাকবে এবং পরিবার পরিকল্পনার অধিকার-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, মাতৃস্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল এবং নারী, কিশোরী ও তরুণদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশে সুযোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা অব্যাহত রাখবে।

