নাগরিক হয়রানির মধ্যেই ভোটার হালনাগাদ শুরু কাল

গাজী শাহনেওয়াজ
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ৩১

হালনাগাদ ভোটার তালিকা কার্যক্রমের বাইরে নতুন কেউ ভোটার হতে চাইলে তাকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়- এমন অভিযোগ করেছেন বেশ কজন ভুক্তভোগী। নতুন ভোটারদের এসব অভিযোগের মধ্যে আগামীকাল সোমবার থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ কাজে ইসির বরাদ্দ ১৯০ কোটি টাকা। রাজধানীর নিকটবর্তী সাভারে প্রধান নির্বাচন নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন উপস্থিত থেকে হালনাগাদ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন।

বিজ্ঞাপন

ইসির সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সর্বোচ্চ দুই মাস হালনাগাদ কার্যক্রম চলে; এর বাইরে সারা বছরই ভোটার হওয়া যায়। বয়স ১৮ বছর হওয়া মাত্রই থানা নির্বাচন অফিসে গিয়ে ভোটার হতে পারেন যে কেউ। এর জন্য মা-বাবার এনআইডি, একাডেমিক সনদ কিংবা জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যয়নপত্র এবং যে কোনো একটি সেবা সার্ভিসের বিলের কপি প্রয়োজন হবে। এসব থাকলেই যাচাই-বাছাইয়ের পর থানা নির্বাচন অফিস তাকে ছবি তুলে ভোটার করে।

অভিযোগ আছে, স্বেচ্ছায় ভোটার হতে ইচ্ছুক নাগরিকরা সেবাদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সেবা পান না। কদিন ঘোরার পর কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে উদ্যম হারিয়ে ফেলেন- এমন অভিযোগ আছে।

এনআইডির কর্মকর্তারা জানান, শর্ত পূরণ হলে সহজেই ভোটার হবেন একজন নাগরিক। কাউকে হয়রানি করার সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে তারা বলেন, তথ্যে ঘাটতি কিংবা ফরম পূরণে ত্রুটি না থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়।

জানতে চাইলে এনআইডির পরিচালক (অর্থ) মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান আমার দেশকে জানান, এ ধরনের অভিযোগ তো মানা যায় না। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। অভিযোগের প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজধানীর মিরপুর, সেকশন-২, ডি-ব্লকের বাসিন্দা উমা রানী চক্রবর্তী। পিতা স্বপন চক্রবর্তী এবং মা সুষমা চক্রবর্তী। সম্প্রতি ভোটার হওয়ার জন্য অনলাইনে ফরম পূরণ করে প্রয়োজনীয় সব তথ্য সন্নিবেশ করেন। সংশ্লিষ্ট সেবাপ্রত্যাশীর ফরম নং-এনআইডিএফএন ১১৭১০৪১৬৬।

ভোটার হওয়ার জন্য দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ১৩ ধরনের কাগজ জমা দেন। যার মধ্যে জন্মনিবন্ধন, বাবা ও মায়ের এনআইডি, নির্বাহী কর্মকর্তার শনাক্ত করা সার্টিফিকেট, শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র, এলাকার একজন ভোটারের শনাক্তকরণ, স্থায়ী ঠিকানার চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট, অস্থায়ী ঠিকানায় ওয়ার্ড সচিবের প্রত্যয়নপত্র, ভাড়াটিয়া চুক্তিপত্র, বাড়িওয়ালা শনাক্ত করে এনআইডিতে স্বাক্ষর এবং ডিএমপিতে জমা দেওয়া ভাড়াটিয়া তথ্য ফরমের কপি। তিনি টানা চার দিন মিরপুর থানা নির্বাচন অফিসে ঘুরেও ভোটার হতে পারেননি।

পরে এ প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটি ম্যাসেজ আসে। সেখানে প্রদীপ চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তি লেখেন, তার এক আত্মীয় সব কাগজ জমা দিয়েও ভোটার হতে পারেননি। চার দিন ঘুরিয়েছেন মিরপুরের থানা নির্বাচন কর্মকর্তা। বলেছেন, ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিসের দেওয়া কাগজে স্থায়ী ঠিকানার উল্লেখ নেই। প্রদীপ বলেন, সেটা তো আবেদনকারীর দোষ নয়। শুধু তারা নন, অসংখ্য মানুষ এই ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন।

জানতে চাইলে মিরপুর থানা নির্বাচন কর্মকর্তা তসলিমা আক্তার আমার দেশকে বলেন, নতুন ভোটার আবেদন সবগুলোই আপলোড করা হয়েছে। আপনি যার বিষয়ে অভিযোগ করছেন, তিনি কি আমার কাছ পর্যন্ত এসেছিলেন?

চার দিন গিয়েছিলেন আপনার অফিসে- এ কথা বললে তিনি বলেন, অভিযোগকারীকে আমার কাছে আসতে বলবেন। সমস্যাটি চিহ্নিত করে সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

মালিবাগের বাসিন্দা ফাতেমা ইয়াসমিনের ভোটার এলাকা নং-১২১২। ২০১৯ সালে প্রবাস থেকে স্থায়ীভাবে দেশে আসেন। সম্প্রতি ভোটার হওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন এবং এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংযোজন করেন। তার ফরম নং-এনআইডিএফএন ১১৭৬১৪২০২। কিন্তু ভোটার হতে পারছেন না বলে অভিযোগ জানালেন।

সম্প্রতি এনআইডির পরিচালক আবদুল মমিন সরকারের কক্ষেই ওই ভুক্তভোগীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। বলেন, সংশ্লিষ্ট থানা নির্বাচন অফিস তাকে ওই অফিসারের কাছে আসতে পরামর্শ দিয়েছেন। কেন জানতে চাইলে বলেন, এই অফিসার প্রবাসীদের ভোটার করার জন্য নিযুক্ত কর্মকর্তা। তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট অফিসার তার পাসপোর্টসহ সার্বিক কাগজ যাচাই করে দেখেন তিনি ২০১৯ সাল থেকেই দেশে আছেন। তাৎক্ষণিক জানিয়ে দেন, এখন আপনি প্রবাসী নন; সংশ্লিষ্ট থানা নির্বাচন কর্তৃপক্ষ ভোটার করার এখতিয়ারভুক্ত। পাশেই দাঁড়ানো ফাতেমার স্বামী অভিযোগ করে আমার দেশকে বলেন, আমি কোথায় গেলে সমাধান পাব বুঝতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি, বলছে আমার এখতিয়ার নয়। আমার স্ত্রীকে কে ভোটার করবে আমি জানি না। হয়রানি হতে হতে আমরা ক্লান্ত।

এদিকে, কাল ২০ জানুয়ারি হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। ওইদিন থেকে টানা ১৫ দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করবেন ইসির নিয়োজিতরা। আর তথ্য সংগ্রহের পর আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে ছবি তুলে ভোটার করা। এবার এ কার্যক্রম সফল করতে ইসির প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে; অথচ সাধারণ নাগরিকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে ভোটার হতে চাইলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।

সূত্র জানিয়েছে, এনআইডির সঙ্গে জড়িত এক শ্রেণির অসাধু চক্র ঘুসের বিনিময়ে কাজ করে। নতুন ভোটার থেকে হারানো কার্ড উত্তোলন ও ভুল সংশোধনেও হয়রানির শিকার হতে হয় নাগরিকদের। এ নিয়ে এন্তার অভিযোগ আছে। গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ সংশোধনের আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। সম্প্রতি ঘুসবাণিজ্যের কারণে দুদকের একটি প্রতিনিধিদল ইসিতে অভিযান চালায়। তখন তাদের হাতে অর্থের বিনিময়ে এনআইডি সংশোধনে দালালচক্রের দুই সদস্য আটক হন।

এ প্রসঙ্গে এনআইডির ডিজি এএসএম হুমায়ুন কবীর আমার দেশকে বলেন, এনআইডি নিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আমি নতুন এসেছি। সবগুলো বোঝার চেষ্টা করছি। নতুন ভোটাররা যাতে হয়রানি না হন, সেটি যেমন দেখব; একইভাবে এনআইডি-জট কমাতে ক্র্যাশ কর্মসূচি নিয়ে নিষ্পত্তির চেষ্টা করব। একটু সময় দিন- যোগ করেন তিনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত