নিষিদ্ধ জালে উৎপাদন-প্রজননের ক্ষতি হয় জানে না ৯৩ শতাংশ জেলে

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ৫০

আয় ও ঋণ নির্ভরতার কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ জেলেপরিবার অবৈধ বা নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে। তবে তাদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ জেলেই জানে না যে, এসব জালের কারণে নদী ও সাগরের জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাছের উৎপাদন ও প্রজনন হ্রাস পায়।

বেঁচে থাকার তাগিদে তারা এসব অবৈধ ও নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, মশারি, প্লাস্টিক জাল, বিন্দি, ঠেলা, খুটা জাল ব্যবহার করছে। তাতে প্রয়োজনীয় মাছ ধরার পাশাপাশি নানা প্রজাতির মাছের পোনা নির্বিচারে মারা যাচ্ছে। সঙ্গে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত শৈবাল, অতিক্ষুদ্র জলজ প্রাণিসহ নানা প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কোস্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

সোমবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমসহ অন্যান্যরা।

সংস্থাটি ২০২৪ এবং ২০২৫ সালের সংগৃহীত তথ্য ও স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ভোলার ক্ষুদ্র জেলেদের বাস্তব চিত্র, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক নীতির সংযোগ বিশ্লেষণ করেছে।

এ সময় তারা গবেষণা এলাকা ভোলার জেলে পরিবারগুলোর বাস্তব চিত্র তুলে ধরে বলেন, ভোলা জেলায় মোট নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। এর প্রায় ৮১ হাজার জেলে পরিবার এখনও সরকারি সহায়তা পাচ্ছে না। তবে ইউনিয়নভিত্তিক তথ্য থেকে দেখা যায়, প্রকৃত ক্ষুদ্র জেলে পরিবারের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অন্তত ২০ হাজারেরও বেশি এখনো সরকারি নিবন্ধনের বাইরে আছেন। শুধুমাত্র ভোলা সদর উপজেলায় প্রকৃত ক্ষুদ্র জেলে পরিবারের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার জন। এরমধ্যে মাত্র ৫৫ শতাংশ পরিবার জেলে কার্ডধারী।

কোস্টের জরিপ অনুযায়ী, ৮৭ শতাংশ পরিবার কখনো কোনো প্রশিক্ষণ বা আইজিএ উপকরণ পায়নি। মাত্র ৫ শতাংশ পরিবার অন্য পেশায় যুক্ত হতে পেরেছে। এর ফলে পরিবারগুলো দাদনদারদের ঋণের ফাঁদে পড়ে এবং ঋণ পরিশোধের জন্য আবারও দাদনদারদের সঙ্গে জড়িত হয়। এই ঋণ নির্ভরতা পরবর্তী মৌসুমে অবৈধ জাল ব্যবহার বা আগাম মাছ বিক্রির চুক্তির দিকে ঠেলে দেয়, যা জেলেদের আত্মনির্ভরতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

গবেষণায় পাওয়া গেছে, ৬৫ শতাংশ জেলে পরিবার ঋণ পরিশোধের জন্য পুনরায় দাদনদারের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, ফলে ঋণচক্র আরও শক্তিশালী হয়।

কোস্ট ফাউন্ডেশন বলছে, প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও ক্ষুদ্র জেলেদের জীবিকা-সংকট সমাধানের কার্যকর কাঠামো এখনো দুর্বল। ক্ষুদ্র জেলে সম্প্রদায় এখনো টেকসই উন্নয়ন ও ন্যায্য অর্থনীতির বাইরে। ফলে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জীবিকা সুরক্ষায় ন্যায্য সহায়তা ও বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টির দাবিও জানিয়েছে সংস্থাটি।

কিন্তু বাস্তবে, এই কার্ডধারী জেলেদের মধ্যেও মাত্র ৪৪ শতাংশ নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারি সহায়তা পান। ফলে পুরো জেলার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, ভোলার ক্ষুদ্র জেলে পরিবারের মোট সহায়তা প্রাপ্তির হার ২৪ শতাংশের নিচে, যা সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা ও বাস্তবায়ন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে। আবার কোস্টের ২০২৫ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৮৩ শতাংশ জেলে পরিবারের কাছে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ১-২ মাস পরে সরকারি পরিষেবায় ধার্যকৃত চাল সহায়তা পৌঁছেছে।

ভোলার ক্ষুদ্র জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সময়টিতে এক নীরব দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। গবেষণায় ৮৭ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের আয়ে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। গড়ে একজন জেলের মাসিক আয় ১০-১৫ হাজার টাকা থেকে কমে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। এই আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকে পারিবারিক কলহ, এমনকি নারীর ওপর সহিংসতা ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।

এ সময় কোস্ট ফাউন্ডেশন জেলেদের টেকসই উন্নয়নে ৯ দফা দাবি জানায়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রকৃত জেলেদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে ইউনিয়ন পর্যায়ে তালিকা প্রকাশ করতে হবে; নিষেধাজ্ঞাকালীন প্রতি মাসে এক জেলে পরিবারকে ন্যূনতম ৮,০০০ টাকা নগদ এবং ৪০ কেজি চাল দিতে হবে; নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার ১৫ দিন আগে সহায়তা প্রদান করতে হবে; দেরি রোধে ডিজিটাল ট্র্যাকিং চালু করতে হবে; ক্ষুদ্র জেলেরা যেন সহজে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে লোন বা ক্রেডিটের ব্যবস্থা করতে পারে তার জন্য যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; বিশেষ করে নারী সদস্য এবং যুব সদস্যদের পশুপালন, হস্তশিল্প, ছোট ব্যবসা ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা দিতে হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত