ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব

তিন সমন্বয়ককে হাসপাতাল থেকে তুলে নেয় ডিবি

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ০৩: ৪৭

কোটা সংস্কার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ তিন সমন্বয়ক—নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা। সেদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডিবি এই তিন জনকে নিজেদের হেফাজতে রাখার কথা স্বীকার করে জানায়, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের আনা হয়েছে এবং সহিংসতার বিষয়ে কোনো তথ্য আছে কি না তা জানতে চাওয়া হবে।

তবে বিকেলেই নাহিদের পরিবার অভিযোগ করে, সাড়ে তিনটার দিকে সাদা পোশাকে আসা একদল ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে প্রথমে নাহিদকে তুলে নেয়। এরপর একে একে আসিফ ও বাকেরকেও তুলে নেওয়া হয়। এর আগেও ১৯ জুলাই মধ্যরাতে নাহিদকে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া থেকে তুলে নিয়ে ২১ জুলাই পূর্বাচলে ফেলে যাওয়া হয়। একই দিনে আসিফ ও বাকেরকেও গুম করা হয় এবং পাঁচ দিন পর ২৪ জুলাই তাদের হাতিরঝিল ও ধানমন্ডি এলাকায় রেখে যাওয়া হয়। তারা তিন জনই গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, তিন সমন্বয়ক নাকি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন এবং ডিবি তাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ ও পূর্ববর্তী গুমের ইতিহাস সেই বক্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

গণগ্রেপ্তার, ব্লক রেইড ও হাসিনার মিথ্যাচার

কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবি নিয়ে রাজপথে নামা হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে দমাতে পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান চালায়। মাত্র ১১ দিনে ৯ হাজার ১২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যার মধ্যে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয় ২ হাজার ৫৩৬ জন। বিশেষ করে আন্দোলনের সমন্বয়করা লক্ষ্যবস্তু হয়।

২৬ জুলাই তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেন, তবে একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির, বিএনপি ও ছাত্রদল বলে অভিযোগ তোলেন। তিনি আন্দোলনকে ‘জঙ্গিবাদী’ আখ্যা দিয়ে জনগণের কাছে দমনপীড়নের অনুমোদন চান।

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও আধুনিক অবকাঠামোয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের জন্য তিনি আন্দোলনকারীদের কঠোর ভাষায় দোষারোপ করেন এবং দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড বলেও উল্লেখ করেন।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে সরকার ‘ব্লক রেইড’ নামে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনকারীদের ওপর ভয়াবহ পুলিশি অভিযান চালায়। রাজধানীসহ ৫৩টি মহানগর ও জেলায় ১০ দিনে অন্তত ৫৫৫টি মামলা হয়, ৬ হাজার ২৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকায় মাত্র ১০ দিনে প্রায় ২ হাজার ৪১৬ জন গ্রেপ্তার হন।

ব্লক রেইড চলাকালে ঢাকার শাহীনবাগ ও বসুন্ধরা এলাকায় পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশ গুলির ঘটনা অস্বীকার করলেও স্থানীয়দের ভিডিওতে গুলির শব্দ পাওয়া যায়।

অভিযানে শুধু ছাত্র আন্দোলনকারীদের নয়, বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল গ্রেপ্তারদের সংখ্যা তিন হাজারের কাছাকাছি বলে জানান এবং সরকারের গুলিতে শত শত শিক্ষার্থী নিহত ও আহত হয়েছেন বলে জানান।

চট্টগ্রামে ১৬ থেকে ২৩ জুলাই অন্তত ৩০ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হন, যাদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নন বলে স্বজনরা জানান।

আওয়ামী লীগের ভেতর দোষারোপ ও বিভাজন

কোটা আন্দোলনের চাপ সামলাতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়। দলের অভ্যন্তরে দোষারোপ ও বিভাজনের আবহ দেখা দেয়। দলের তরুণ প্রজন্মের বিক্ষুব্ধতা নেতাদের উদ্বেগের কারণ হয়। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কোটা আন্দোলনে দলের ভূমিকা ভঙ্গুর ছিল বলে স্বীকার করেন। বিভিন্ন নেতার মধ্যে সংঘাত ও তিক্ততা প্রকাশ পায়। ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দলের অনেক নেতা হতাশা প্রকাশ করেন এবং সতর্ক করেন, দলের আদর্শ ও ঐক্য বজায় রাখতে হবে।

কোটা আন্দোলনের সময় হাসপাতালগুলো নিহত ও আহতের তথ্য গোপন করায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাজধানীর পাঁচটি প্রধান হাসপাতালে অন্তত ৯ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ হাসপাতাল তথ্য প্রকাশে অনীহা দেখায়।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেসে ১৩২ জন আহত চিকিৎসা নিতে গেলে ৬ জন মারা যান। মুগদা মেডিকেল কলেজেও তিন জনের মৃত্যু হয়।

নিহতদের পরিবার অভিযোগ করে, চিকিৎসা ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত ছিল এবং অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ লাশের যথাযথ যত্ন নেয়নি। তথ্য গোপন করতে সরকারের পক্ষ থেকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত