আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবার চট্টগ্রাম বন্দরের বর্ধিতাংশ বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডিপো মালিকরা। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে অঘোষিতভাবে ডিপোর কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বড় শিপিং লাইনসগুলোকে কনটেইনার না পাঠানোর বিষয়টি মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ কিংবা দেশের বন্দর ব্যবহারকারী কোনো প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি জানানো হয়নি। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সব ধরনের রপ্তানিপণ্য জাহাজীকরণ ও এমটি কনটেইনার হ্যান্ডলিং পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে তৈরি পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, শতভাগ রপ্তানিপণ্য, খালি কনটেইনারের বড় অংশ ও ৬৫ ধরনের আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং করে ১৯টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপো বা অফডক কর্তৃপক্ষ। অফডকের অপারেশন বন্ধ হলে মুখ থুবড়ে পড়বে পুরো বন্দরের কার্যক্রম। তাই এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিপর্যয় নামবে জাতীয় অর্থনীতিতে।
অফডক সূত্র জানায়, কনটেইনার স্টাফিং, গ্রাউন্ড রেন্ট, লিফট অফ-লিফট অন, ডকুমেন্টেশন ও বন্দর থেকে অফডকগামী পরিবহনের নতুন ট্যারিফ কার্যকর করার উদ্যোগ নেয় বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডা। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে উদ্যোগ নিয়ে সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকে নির্ধারিত চার্জের চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষ ৩০ থেকে ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে আদায় করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বিষয়টি নিয়ে তীব্র আপত্তি জানান বন্দর ব্যবহারকারীরা। নতুন নির্ধারিত চার্জ পরিশোধ না করার ঘোষণাও দেন তারা। বিষয়টি নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কয়েক দফা সমঝোতার উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের নির্দেশে বর্ধিত মাশুল আদায় স্থগিত করতে বাধ্য হয় অফডক কর্তৃপক্ষ।
এর পরও বিষয়টি আদালতের বাইরে সমাধানের উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দুপক্ষই তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। উপায়ান্তর না পেয়ে পুরো বিষয়টি অবগত করে সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়ে দেয়, ট্যারিফ কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া অফডক কর্তৃপক্ষ বন্দর ব্যবহারকারীদের ওপর নতুন কোনো মাশুলের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারবে না। আদালতের নির্দেশনা ও মন্ত্রণালয়ের সায় না পেয়ে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি করে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করলেও আগের ট্যারিফে সেবা অব্যাহত রাখতে বাধ্য হয় অফডক মালিকদের সংগঠন বিকডা।
তবে তিন মাস পর নতুন ফন্দি এঁটেছে সংগঠনটি। দাবি আদায়ে এবার কোনো ধরনের ঘোষণা না দিয়েই ১১ ডিসেম্বর থেকে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। তবে বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছে। বড় কয়েকটি শিপিং লাইনসকে মৌখিকভাবে বৃহস্পতিবার থেকে কনটেইনার না পাঠাতে বলে দিয়েছে তারা। তবে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, শিপিং এজেন্ট কিংবা বন্দর কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি।
বেসরকারি কনটেইনার মালিকদের সংগঠন বিকডার সেক্রেটারি রুহুল আমিন শিকদার জানান, বহু বছর ধরে অফডকের মাশুল বাড়ানো হয়নি। কিন্তু পরিচালনার ক্ষেত্রে সব খাতে খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। এ বাস্তবতায় অফডকের মাশুল বাড়ানোর বিকল্প নেই। বন্দরসহ সবগুলো প্রতিষ্ঠানে মাশুল বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অফডকের মাশুল বাড়াতে গেলেই একটি পক্ষ আদালতকে ব্যবহার করে মাশুল বাড়ানোর প্রক্রিয়া আটকে দেয়। এতে দীর্ঘদিন ধরে লোকসান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে অফডক কর্তৃপক্ষ। এভাবে আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই অফডক কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১১ ডিসেম্বর থেকে রপ্তানি ও খালি কনটেইনার হ্যান্ডলিং না করার। তবে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার আনলোড করা হবে। অফডক মালিকদের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিকডার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ডিপো মালিকরা লোকসান গুনতে পারছেন না বলেই আপাতত ব্যবসা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, বেসরকারি ডিপো হলেও অফডক বন্দরের একটি অংশ। ২০১৬ সালের আইসিডি নীতিমালা অনুযায়ী শিপার-কনসাইনি-এমএলও-শিপিং এজেন্ট-ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আইসিডির ট্যারিফ নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি আছে। ওই কমিটির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া একতরফাভাবে কোনো চার্জ নির্ধারণ করার সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়ও এ কথাই বিকডাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। কোনো নোটিস না দিয়ে কারো সঙ্গে কথা না বলে কাজ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। ১১ ডিসেম্বর থেকে অফডক কর্তৃপক্ষ কাজ বন্ধ রাখবে, এমন কোনো সিদ্ধান্তের কথা বন্দর কর্তৃপক্ষকে কেউ জানায়নি বলেও জানান তিনি।
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন জানান, বড় শিপিং লাইনসগুলোকে অফডক কর্তৃপক্ষ কনটেইনার না পাঠাতে বলেছে। বিষয়টি দেশের ভাবমর্যাদার জন্য ক্ষতিকর। কারণ, বন্দরের ব্যবসা আন্তর্জাতিক ব্যবসা। এখানে নেতিবাচক কিছু হলে তাতে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর প্রভাব পড়ে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, কাজ বন্ধ রাখার বিষয়টি দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে তারা জানায়নি। কারো সঙ্গে আলোচনা না করে বন্দরের কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিজিএমইএর সহসভাপতি রফিক উদ্দিন চৌধুরী জানান, অফডক কর্তৃপক্ষ কাজ বন্ধ রাখবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বিজিএমইএকে জানানো হয়নি। এ কারণে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে অফডকের কাজ বন্ধ রাখা এককভাবে অফডক কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বায়াররাই নির্ধারণ করে দেন তার পণ্য কোন অফডক হ্যান্ডলিং করবে। তাই সরাসরি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে অফডক কর্তৃপক্ষ জড়িত। এ বাস্তবতায় কোনো নোটিস ছাড়া যদি হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দেয়, তবে তা দেশের ভাবমর্যাদার জন্য ক্ষতিকর হবে।

