২৮ ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আগুন, কারণ অজানা

ওয়াসিম সিদ্দিকী
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৩: ০৮
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে গার্মেন্ট ভবন ও রাসায়নিকের গুদামের ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ২৮ ঘণ্টার চেষ্টায় গতকাল বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও জানা যায়নি অগ্নিকাণ্ডের কারণ। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে ঘটনার পর থেকে মালিক পক্ষের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

কারখানা ও গুদামের আগুনে ঘটনায় ১৬ জনের লাশ উদ্ধারের পর বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দায়-দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শিয়ালবাড়ির আলম ট্রেডার্স নামের ওই গুদামের বাইরে সেফটি ডেটা শিট (এসডিএস) ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী যেকোনো রাসায়নিকের গুদামে এসডিএস থাকা বাধ্যতামূলক। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। যত্রতত্র নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই রাসায়নিক মজুত করাহচ্ছে। একেকটি ঘটনা ঘটলে কিছুদিন এ বিষয়ে আলোচনা চললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

বিজ্ঞাপন

টানা ২৮ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম। সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট কাজ করছিল। গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর সড়কে অবস্থিত টিনশেড রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটে। আগুনের তীব্রতায় পাশের চারতলা ভবনের দুই তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

সেখানে ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া রাসায়নিক গুদামের ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে, যা এলাকাবাসীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় পোশাক কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও গুদামের আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করতে হিমশিম খেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। ভবনটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে তল্লাশি কার্যক্রম চালাচ্ছে না ফায়ার সার্ভিস। গতকাল বিকালে প্রেস ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এ তথ্য জানান।

ফায়ার সার্ভিসের তৈরি করা অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রাসায়নিক গুদাম আলম ট্রেডার্সও ছিল বলে জানান এই কর্মকর্তা। তাজুল ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি তিনবার ওই গুদামে নোটিসও দেওয়া হয়েছিল। ওই গুদাম অভিযান চালানোর পর্যায়ে ছিল।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ ধরনের রাসায়নিকের গুদাম অবিলম্বে আবাসিক এলাকা থেকে সরানো প্রয়োজন। সরকারকে দ্রুত তদন্ত করতে হবে এবং সংশ্লিষ্টদের বিচার করতে হবে।’

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, রাসায়নিকের গুদামের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু এখনো তার অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি বিশেষজ্ঞ দলও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং তারা দ্রুত তদন্ত শুরু করবে। ফায়ার সার্ভিস জানাচ্ছে, রাসায়নিকের অবস্থান, তাপমাত্রা এবং গুদামের নিরাপত্তাব্যবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, গুদাম মালিক পলাতক রয়েছে, মোবাইলে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, রাসায়নিক গুদামগুলোতে ব্যবহৃত রাসায়নিকের মজুত যদি সঠিক নিয়ম অনুসারে না করা হয়, তবে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে, যা আরো বিপজ্জনক পরিস্থিতির তৈরি করতে পারে। রাসায়নিকের অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোর তারতম্য ঘটলে, রুমের তাপমাত্রা এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা না থাকলে বৈদ্যুতিক সুইচ দেওয়ামাত্রই বিস্ফোরণ হতে পারে। অনেক সময় বিদ্যুৎ কিংবা অন্য কোনো ধরনের সামান্য স্পার্ক থেকেও বিস্ফোরণ হতে পারে।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. নজমুজ্জামান ব্রিফিংয়ে জানান, রাসায়নিক গুদামের ভেতরে প্রচণ্ড ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস ছিল। এগুলো মানবদেহের জন্য মারাত্মক। এসব গ্যাসে শ্বাস নিলে ত্বক, ফুসফুস ও হার্টের সমস্যাসহ প্রাণনাশ হতে পারে। তিনি আরো বলেন, ‘রাসায়নিকের গুদামগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। এসব জায়গায় আগুন লাগলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।’

রাসায়নিকের আগুন বিপজ্জনক উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী গুদামজাত না করা হলে রাসায়নিক একসঙ্গে হয়ে বড় ধরনের বিস্ফোরণ-বিক্রিয়া হতে পারে। যে কারণে এখানে সময় লেগেছে।

অগ্নিকাণ্ডের পর স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, এসব গুদাম আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠার কারণে নিরাপত্তার বিষয়টি আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে মিরপুর, পুরান ঢাকা, তেজগাঁও ও রূপনগরে অবৈধ রাসায়নিকের গুদাম আছে। এসব গুদামে মজুত থাকা রাসায়নিকের মধ্যে ব্লিচিং পাউডার, ফসফেট, ক্লোরিন, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ বেশ কিছু অত্যন্ত ক্ষতিকর পদার্থ আছে, যেগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তৈরি করে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, মালিক অথবা কর্মচারীরা পলাতক বিধায় এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায় মেটা, পার অক্সাইড, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, এনজাইম, লবণ, ব্লিচিং পাউডার এই আলম টেডার্সের গোডাউনে ছিল। তদন্ত করে বিস্তারিত জানা যাবে।

২০০৯ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে ১২৪ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। এরপরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি এবং এসব গুদাম সরানোর উদ্যোগে ব্যাপক গাফিলতি প্রকাশ পায়। যদিও ২০১৮ সালে কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক পল্লী নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তবে প্রকল্পটির অগ্রগতি খুবই ধীর।

ভবনে ফাটল

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বলেন, মিরপুরে যে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগেছিল সেই ভবনের অনেক জায়গায় ফাটল ধরেছে, ভবনটির ড্যামেজ হয়েছে। যখন তখন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে আমরা আশঙ্কা করছি। কলামে ফাটল ধরেছে। এটা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। এগুলো যাচাই না করে সার্চ অপারেশন চালানো কঠিন হবে। আলম ট্রেডার্সের মূল দরজা তালাবদ্ধ ছিল এবং সেটি কাটার দিয়ে কেটে খুলতে হয়েছে।

তিনি জানান, ‘যেহেতু তালাবদ্ধ ছিল সেহেতু ধারণা করা হচ্ছে এখানে মানুষ ছিল না। তারপরও সার্চ অপারেশন না চালানো পর্যন্ত বলা যাবে না যে মানুষ ছিল কি না। সার্চ অপারেশন করতে সময় লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘ভবনের স্ট্রাকচারাল ইস্যুটি আগে দেখতে হবে। আমরা এখন প্রগ্রেসিভ ওয়েতে যতটা সম্ভব কেমিক্যাল ড্রেন আউট করছি। এটা করে কুলিং প্রসেস চালাচ্ছি। কেমিক্যালের ড্রেন আউটের জন্য আরো সময় দরকার হবে। ৩৬ ঘণ্টাও লাগতে পারে, ৭২ ঘণ্টাও লাগতে পারে।’

স্থপতি ও নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এ ধরনের দুর্ঘটনা আসলে আমাদের নগর পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক অবহেলার পরিণতি। কর্তৃপক্ষের কোনো জবাবদিহি না থাকায় অবৈধ রাসায়নিক গুদামগুলো শহরের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে। এগুলোর বিস্ফোরণ সম্ভাব্যতা খুবই ভয়াবহ এবং এগুলো নগরীর নিরাপত্তার জন্য একটি টাইম বোমার মতো।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত